আসহাবে রাসুলের জীবনকথা (১ম থেকে ৬ষ্ট খ্ণ্ড)
রিয়াদুস্সালীহিন (২টি বই)
রাহে আমল ১ম ও ২য়-খণ্ড (২টি বই)
হাদীসের আলোকে মানব জীবন ১ম ও ২য় খন্ড (২টি বই)
আমার সংক্ষিপ্ত আত্ম কাহিনী – এ.কে.এম ইউসুফ
আমার সংক্ষিপ্ত আত্ম কাহিনী
- আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ (মোমতাজুল মুহাদ্দেছীন)
আদি বাসস্থান ও সেখান থেকে স্থানান্তরঃ
আমাদের আদি বাড়ি ছিল বরিশাল জেলাধীন বাণারিপাড়া থানার চাখার গ্রামে। চাখার একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম। যুক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী মরহুম শেরে বাংলার পিতা ছিলেন এই গ্রামের আধিবাসী। এ গ্রামে তখন বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত পরিবার বসবাস করত। ফলে গ্রামটি ছিল প্রসিদ্ধ। আমার পিতার মুখে শুনা, আব্বার দাদা জহিরুদ্দীন হাওলাদার এখান থেকে এসে বরিশাল জেলার মঠবাড়িয়া থানাধীন মাছুয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। আমার দাদা আপিলুদ্দীন হাওলাদারের জন্ম যতাসম্ভব এই গ্রামে। এখান থেকে এসে আমার দাদা বর্তমান শরনখোলা থানার রাজইর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তখন এ এলাকাটা পুরাটাই মোড়েলগঞ্জ থানার অধীনে ছিল। অনেক পরে পরবর্তি এক সময় মাত্র চারটি ইউনিয়ন নিয়ে ফাড়ি থানা হিসেবে শরন খোলা থানা সৃষ্টি করা হয়। তখন মোড়েলগঞ্জ থানার প্রায় সব এলাকা জুড়ে সুন্দরবন ছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দির শেষের দিকে ব্রিটেনের নাগরিক মোড়েল সাহেব তদানিন্তন বাঙ্গীয় বৃটিশ প্রশাসনের কাছে থেকে পুরা এলাকাটি তার জমিদারী হিসেবে নিয়ে নেন। অতপর মোড়েল সাহেবের নামানুসারে এলাকাটর নামকরণ করা হয় মোড়েলগঞ্জ থানা। মোড়েল সাহেব তার জমিদারীর অন্তর্ভূক্ত সুন্দরবনের জমি আবাদ করে বাসপোযোগী ও চাষপোযোগী করার জন্য নামে মাত্র খাজনায় পত্তন দেয়ার জন্য ঘোষণা দেন। তখন পার্শ্ববর্তী বিরিশাল জেলা হতে বেশ কিছু লোক এসে মোড়েল সাহেবের প্রজা হিসেবে নামে মাত্র খাজনার বিনিময়ে জমি পত্তন নিয়ে জংগল কেটে জমি আবাদ করে। এ সময় আমাদের দাদা আপিলুদ্দীন হাওলাদারও অন্যান্য লোকের সাথে রাজইর গ্রামে এসে জমি পত্তন নেন এবং জংগল ছাফকরে সবতি স্থাপন করেন। তখন নাকি এ এলাকায় বাঘ, শুকর ও সাপের বেশ উপদ্রব ছিল। খুব সহসী ও দুর্ধর্ষ লোক ছাড়া এখানে অন্য কেহ বসবাস করতে সাহস করত না।
আমার পিতা ও পিতামহঃ
আমার পিতা আজিমুদ্দীন হাওলাদার যথাসম্ভব ১৮৯৮ কিংবা ১৮৯৯ সনে রাজইর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। আমার দাদা দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে অল্প বয়সেই মারা যান। আমার আব্বা ছিলেন তিন জনের মধ্যে বড়্ আমার ছোট চাচা ও ফুফী অল্প বয়সেই মৃত্যুবরণ করেন। আমার বিধবা দাদী আমার আব্বাকে নিয়ে রাজইরের বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন। আমার দাদী ছিলেন প্রখর বুদ্ধিমতি ও সাহসী। তাকে আমি দেখেছি। আমার মাইনর স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি পরকলোক গমন করেন।
আমার মাতা ও মাতামহঃ
আমার মাতা ছিলেন আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম মঠেরপার নিবাসী মরহুম সিরাজুদ্দীন হাওলাদারের কন্যা। আমার নানাও দুই ছেলে ও এক কন্যা রেখে আমার দাদার ন্যায় অল্প বয়সে মারা যান। আমার নানি দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ অল্প বয়সে বিধবা হন। আমার নানি ছিলেন বরিশাল জেলার তেলিখালী গ্রামের মেয়ে। নানির ভাইয়েরা নানিকে অল্প বয়সী হওয়ার কারনে তেলিখালী নিয়ে দ্বিতীয় বিবাহ দেন। ফলে আমার মা ও দুই মামা তাদের দাদা-দাদীর কাছে লালিত-পালিত হতে থাকেন। মায়ের দাদা হাজি নাসরুদ্দিন ছিলেন এলাকার খুবই গণ্যমান্য ও শদ্ধেয় ব্যক্তি। আমা বড় হলে পরে আম্মার গার্জিয়ান ও আমার দাদীর আগ্রহ ও অনুরোধে আম্মাকে আমার আব্বার সাথে বিবাহ দেন।
আমার জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষাঃ
আমার জন্ম ১৯২৬ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথমার্ধে (বাংলা ১৩৩২ সনের মাঘ মাসে)। আমি আমার পিতা মাতার তৃতীয় সন্তান। জন্মস্থান রাজইর গ্রামে আমার পিত্রালয়।
আমার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় আমার গ্রামের গ্রাম্য মক্তবে। মক্তব হতে নিম্ন প্রাইমারী পাশ করার পরে আমার পিতা আমাকে রায়েন্দা বন্দরের মাইনর স্কুলে নিয়ে ভর্তি করে দেন। আল্লাহর রহমতে আমি পড়াশুনায় খুবই ভাল ছিলাম। আমার স্বরণশক্তি যেমন প্রখর ছিল, তেমনি মুখস্ত শক্তিও ছিল খুব উত্তম। আমার পিতা আমাদের লেখা পড়ার প্রতি খুবই যত্নবান ছিলেন। তিনি নুতন ক্লাশে উঠার সাথে সাথেই আমাদের সমস্ত বই কিনে দিতেন। আর বই হাতে পেয়েই নুতন ক্লাসের পড়া শুরু হওয়ার আগেই আমি বইয়ের সমস্ত পদ্যগুলি মুখস্ত করে ফেলতাম। গদ্য-পদ্য সহ বইয়ের অধিকাংশ স্থান পড়তে গিয়ে আমার মুখস্থ হয়ে যেত। মাদ্রাসায় পড়াকালীন অবস্থায়ও পাঠ্যভুক্ত কিতাবের অধিকাংশ জায়গা আমার মুখস্থ হয়ে যেত। মাইনর স্কুলের পড়া সমাপ্তিতে আমি আমার আম্মার আগ্রহ ও উৎসাহে বরিশাল জেলার গুলুয়া মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হয়ে দরসে নেজামী লাইনের পড়া-শুনা শুরু করি।
এ সময় এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই নিম্নমানের। তখন জমিদারী সিসটেম থাকার কারনে জমিদার, গ্রামের প্রজাদের অর্থ লুটে নিয়ে শহর-বন্দরে আরামের জিন্দেগী যাপন করত। গ্রামে রাস্তা-ঘাট বলতে কিছু ছিল না। তখনকার লোকেরা প্রকৃতির তৈরী প্রবাহিত খালের দুই পাড়ে সারিবদ্ধাভাবে বাড়ি করত। কেননা যোগাযোগের ও মালামাল বহনের জন্য পানিতে চালিত নৌকাই ছিল তাদের বাহন। রাস্তা ঘাট ও গাড়ি ইত্যদির কোন ব্যবস্থা তখন এলাকায় এমনকি বন্দর ও থানা সদরেও ছিল না। একমাত্র নৌকা ও পা ছিল মানুষের চলাচলের প্রধান বাহন।
তখন ছিল আমাদের দেশ ব্রিটিশ শাসনের অধীন। ব্রিটেনের সিবাসা নামক এক ইংরেজ কোম্পানীর একখানা ছোট জাহাজ বাগেরহাট ও হুলার হাটের মধ্যে চলাচল করত। এই জাহাজের একটা স্টেশান ছিল আমাদের নিকটবর্তী বন্দর রায়েন্দায়্ আমি এই জাহাজে বিশ পয়সা ভাড়া দিয়ে টিকেট কেটে বরিশাল জেলার ভান্ডারিয়া বন্দরে নেমে পায়ে হেটে গালুয়া মাদ্রাসায় যেতাম। তিন বৎসরকাল আমি গালুয়া মাদ্রাসায় পড়া-শুনা করে শর্ষীনা আলীয়া মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হই।
১৯৩৯ সনে যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়, তখন আমি গালুয়া মাদ্রাসার ছাত্র। মূলতঃ যুদ্ধ প্রথম দিকে জার্মান ও ব্রিটেনের মধ্যে শুরু হলেও পরে গোটা বিশ্ব এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আমাদের দেশে তখন ছিল ব্রিটিশ শাসন। তখন বৃহত্তর বাংলাদেশের রাজধানী ছিল কলিকাতায়। আর বৃহত্তর ভারত অর্থাৎ বর্তমান ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় রাজধানী ছিল দিল্লী। বৃটিশ শাসিত বাংলাদেশে তখন মন্ত্রীসভা ছিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবের নেতৃত্বে। ফজলুল হকে সাহেব বাংলার আপামর জনগণের কাছে কৃষক দরদী বলে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তিনি কৃষক প্রজাপার্টি নামে পার্টি করে জমিদারদের শোষনের বিরুদ্দে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কৃষকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলেন। ফলে সেই সময়ের নির্বাচনে কৃষকরা ভোট দিয়ে ফজলুল হক সাহেবের দলকে বিজয়ি করে।
শর্ষিনা হতে বিদায় ও আমতলী মাদ্রাসায় ভর্তিঃ
শর্ষিনার আবহাওয়ায় আমার স্বাস্থ্য না টেকায় আমি শর্ষিনা হতে বিদায় নিয়ে আমতলী মাদ্রাসায় এসে ভর্তি হই। এ মাদ্রাসা ছিল আমার গ্রামের বাড়ি হতে ছয় কিলোমিটার দূরে। এ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হযরত মাওলানা আব্দুল লতীফ সাহেব। তিনি দেওবন্দ মাদ্রাসার ডিগ্রীধারী একজন উচ্চমানের আলেম ছিলেন। তিনি ফুরফুরার মরহুম পীর আবু বকর সিদ্দিকী সাহেবের মুরীদ ও খলিফা ছিলেন।
আমতলী মাদ্রাসায় আমি একাধারে চার বছর পড়া-শুনা করি। প্রকাশ থাকে যে, আমি পড়া-শুনায় ভাল হওয়ার কারণে, আর পরীক্ষায় সবসময় প্রথম স্থান অধিকার করার কারণে আমার ওস্তাদগণ সকলেই আমাকে অত্যাধিক স্নেহ করতেন। আমতলী মাদ্রাসায় তখন আমি উচ্চমানের কয়েকজন প্রতিভাধর বুজর্গ ওস্তাদের সাহচার্য লাভ করে তাদের কাছ থেকে তাফসিরুল কোরআন, হাদীস, নাহু ছরফ সহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করি। এই মাদ্রাসা হতেই ১৯৪৮ সনে আমি আলিম পরীক্ষায় পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা বোর্ডের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সরকারী বৃত্তি লাভ করি।
আমতলী মাদ্রাসা হতে বিদায় ও ঢাকা সরকারী আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তিঃ
আমতলী মাদ্রাসা হতে বিদায় নিয়ে আমি ঢাকা সরকারী আলীয়া মাদ্রাসায় গিয়ে ফাজিল ক্লাসে ভর্তি হই। ১৯৪৭ সনে যখন বাংলাদেশ বিভক্তির ফয়সালা হয়, তখন সেই সময়ের কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসার সুযোগ্য প্রিন্সিপাল খান বাহাদুর জিয়াউল হক নাজিমুদ্দীন মন্ত্রী সভার অনুমোদন নিয়ে কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে তার যাবতীয় সহায় সম্পদ ও বিরাট লাইব্রেরীর কিতাবাদি ও ফার্র্নিচার ইত্যাদিসহ সামুদ্রিক জাহাজে করে ঢাকায় স্থানান্তর হন। সে সময়ের আলীয়া মাদ্রাসার সুযোগ্য ওস্তাদগণও হিজরত করে কলিকাতা হতে ঢাকায় চলে আসেন। আমি যখন ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হই, তখন আলীয়া মাদ্রাসার প্রিসিনসপাল ছিলেন খান বাহাদুর জিয়াউল হক, হেড মাওলানা ছিলেন হযরত মওলানা জাফর আহমদ ওসমানী, আরবী আদবের শিক্ষক ছিলেন মাওলানা আব্দুর রহমান কাশগরী, তাফসীরের ওস্তাদ ছিলেন মাওলানা হুজ্জ্বাবুল্লাহ লাখনবী ও ফখরেবা,লাগার মাওলানা নাসির ভোলাবী। এছাড়া মুফতী আমিমুল ইহসান ও মাওলানা নাজির আহমদ সহ বেশ কয়েকজন হাদীসের ওস্তাদও ছিলেন। আমি ওসমানী সাহেব ও মুফতী আমিমুল ইহসানের কাছে বোখারী শরীফ পড়েছি।
১৯৫০ সনে ফাজিল পরীক্ষায় পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করে আমি সরকারী বৃত্তি লাভ করি। টাইটেল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সহিত পাশ করে মুমতাজুল মুহাদ্দেসীন উপাধি লাভ করি।
ছাত্র জীবনে, ছাত্র জীবনের বাইরে আমার তৎপরতাঃ
ছাত্র জীবনেই আমি বেশ রাজনৈতিক সচেতন ছিলাম। যুক্ত ভারতে (ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে) তখন চলছিল ব্রিটিশ শাসন। এই ব্রিটিশ শাসনের নাগ-পাস হতে মুক্তি লাভ করার জন্য হিন্দু প্রধান কংগ্রেসের নেতৃত্বে ও মুসলিম প্রধান মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পৃথক পৃথক আন্দোলন চলছিল। কংগ্রেসের দাবী ছিল স্বাদীন অখন্ড ভারত, আর মুসলিম লীগেরে দাবী ছিল মুসলিম প্রধান প্রদেশ সমূহের সমন্বয় স্বাধীন পৃথক দেশ পাকিস্তান। আমি তখন কলিকাতা হতে প্রকাশিত মুসলিম লীগের মুখপত্র দৈনিক আযাদ ও কংগ্রেসের মুখপত্র বসুমতির নিয়মিত পাঠক ছিলাম। যাতে স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ের কার্যক্রম সম্পার্কে অবহিত হতে পারি। এ ছাড়া দিল্লী ও লাহোর হতে প্রকাশিত দুটি সাপ্তাহিক উর্দ্দু পিত্রিকাও আমি নিয়মিত পড়তাম। মাসিক মুহাম্মদী, মাসিক সওগাত ও শিশু সওগাতেরও আমি পাঠক ছিলাম। ছাত্র জমিয়তের মাধ্যমে জমিয়তের লাইব্রেরীতে প্রচুর বই আমি সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করেছিলাম। আর এসব বই আমিও পড়তাম, আর ছাত্রদেরকেও পড়ার জন্য উৎসাহিত করতাম।
যেহেতু আমি জমিয়তে তালাবার নেতা ছিলাম। তাই ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও বহির্মুখী প্রতিভা বিকাশের জন্য নিয়মিত আলোচনা সভা ও প্রতিযোগিতামূলক সভা সমিতি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতাম। ছাত্র জীবন থেকেই আমি এলাকার রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও নির্বাচনী তৎপরতায় আগ্রহের সাথে রাজনৈতিক কর্মীর মত অংশগ্রহন করতাম।
প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা, বিষয় ভিত্তিক বক্তৃতা প্রতিযোগিতা ও প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলায়ও আমি আগ্রণী ছিলাম, তবে যেসব বহির্মূখী তৎপরতা আমাকে কখনও আমার মূল লেখা-পড়া হতে গাফেল বা অমনোযোগী করতে পারেনি। বরং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সব সময় আমি প্রথম স্থান অধিকার করেছি।
আমি যখন ১৯৪৫ সনে আমতলী মাদ্রাসার ছাত্র, তখন কলিকাতা মুহাম্মদ আলি পার্কে দেওবন্দের হযরত মাওেলানা সাব্বির আহম্মদ ওসমানী ও বালাদেশের হযরত মাওলান আব্দুল হাই সিদ্দিকীর নেতৃত্বে নিখিল ভারত ওলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের কার্যক্রম আমি পত্রিকার মাধ্যমে এবং সম্মেলনে যোগদানকারী আমার ওস্তাদ আমতলীর হযরত মাওলানা আব্দুল লতিফ সাহেবের মাধ্যমে অবহিত হয়েছিলাম। মুহাম্মদ আলী পার্কের এই ওলামা সম্মেলন হতে পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন দানের ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে পাকিস্তান আন্দোলন সমগ্র উপমাহাদেশে মুসলমানদের সমর্থন লাভ করে। আমি ছাত্র ও স্বল্প বয়সি হলেও সব সময়ে মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলাম। ১৯৪৬ সনে পাঞ্জম ক্লাসে জামেয়া পরীক্ষা দেয়ার জন্য (তখন নোয়াখালী জেলায়, জেলা ভিত্তিক পাঞ্জম ক্লাশে একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা হত) আমি নোয়াখালীর টুমচর মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হই। তখন চলছিল দেশভিত্তিক জাতীয় নির্বাচন। ইস্যু ছিল পাকিস্তান না অখন্ড ভারত। টুমরে আমার ওস্তাদরা দস্তুর মত দুভাগে বিভক্ত ছিলেন। এক ভাগ দেওবন্দের হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীর সমর্থনে কংগ্রেসের পক্ষে। আর এক ভাগ আল্লামা সাব্বির আহমদ ওসমানী আর উব্দুল হাই সিদ্দীকি সাহেবের সমর্থনে মুসলিম লীগের পক্ষে। দুটি গ্রুপই বেশ শক্তিশালী ছিল। ওস্তাদদের এই গ্রুপিংয়ে আমি বেশ চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়ি। আমি কোন পক্ষ অবলম্বন করব, এটা ভেবে খুবই পেরেশানীবোধ করছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত একটা খাব (স্বপ্ন) আমাকে পথ প্রদর্শন করে। খাব কোন হুজ্জ্বতে শরয়ী’ নাহলেও রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন উত্তম খাব নুবুয়াতের ৪০ ভাগের এক ভাগ।
উপরে যে খাব বা স্বপ্নটির কথা আমি উল্লেখ করেছি তা হল এই যে, ‘আমি আমার ওস্তাদদের দুই গ্রুপের পরস্পর বিরোধী অবস্থানে কোন গ্রুপকে সমর্থন করব এটা চিন্তা করে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়ি। হঠাৎ স্বপ্নে দেখি যে হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী ইলেকশান ক্যাম্পেনের জন্য ট্রেনযোগে লক্ষ্মীপুর ষ্টেশনে এসেছেন। আমরা বেশ কিছু লোক মিলে তাকে অভ্যার্থনা জানাতে গিয়েছি। তিনি আসলেন এবং আমাদের সামনে ছামান পত্র নিয়ে স্টেশানে অবতরন করলেন। স্টেশানে নেমে আমাদেরকে বললেন, ‘আমার কাছে গান্ধীজির বাক্স ও বেডিং রয়েছে। উহা তাকে পৌছাতে হবে’। ব্যাস এই স্বপন দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, আমি স্বপ্নের মাধ্যমে দিক নির্দ্দেশনা পেলাম যে, আল্লামা সাব্বির আহমদ ওসমানী ও হযরত আব্দুল হাই সিদ্দিকী সাহেবের গৃহিত পথই ইসলাম ও মুসলমানের সেবার পথ। আর হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীর পথ হিন্দু নেতা গান্ধী ও হিন্দু কংগ্রেসের সেবার পথ। সুতরাং এর পর আমি কংগ্রেস সমর্থক ওস্তাদদের পথ বাদ দিয়ে, মুসলিমলীগ সমর্থক ওস্তাদদের পথ অবলম্বন করলাম। আমি হযরত মাদানী সাহেবের গৃহিত পথকে তার ইজতেহাদী ভুল বলে গ্রহন করলাম। আর আয়েম্মাদের সর্বসম্মত মত যে মুজতাহিদ ইজতেহাদে ভুল কারলে তার গুনাহ হবেনা ঠিকই, তবে ভুলর খেসারত বা মাশুল অবশ্যই দিতে হবে।
আমি আমতলি মাদ্রাসায় আলিম ক্লাসে পড়াকালিন আমাদের মাদ্রাসায় যুক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মরহুম হুসাইন সরওয়ারদী, নওয়াবজাদা খাজা নসরুল্লাহ সহ বেশ কয়েকজন মুসলিম লীগের প্রাদেশিক মন্ত্রী ও নেতাদের প্রগ্রাম হয়। ছাত্রদের পক্ষ হতে এই সভায় মূখ্য মন্ত্রী সরওয়ারদী সাহেবরে উদ্দেশ্যে মান পত্র আমাকেই পড়তে হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শর্ষিনা মাদ্রাসায় ১৯৪৭ সনে যে নিখিল ভারত ওলামা সম্মেলন হয়, আমতলীর আমার ওস্তাদ হযরত মাওলানা আব্দু লতিফ সাহেবের সাথে ঐ সম্মেলনে আমিও যোগদান করেছিলাম। ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালেও আমি জমিয়তে তালাবার নেতা হিসেবে অনেক প্রানবন্ত ও আকর্ষনীয় প্রগ্রাম করেছি, যা দেখে আমার ওস্তাদরা আমাকে খুবই উৎসাহিত করেছিলেন। এভাবেই আমি আমার ছাত্র জীবনেও বিভিন্নমূখী কার্যক্রম আনজাম দিয়েছি।
আমার পারিবারিক জীবনঃ
১৯৪৯ সনের জুন মাসে আমার বিবাহ হয়। আমি তখন ফাজিল ১ম বর্ষের ছাত্র। আমার শ্বশুর মরহুম হাজী আহেজদ্দীন মোল্লা ছিলেন মোড়েলগঞ্জ থানাধীন ফুলহাতা গ্রামের অধিবাসী। তার দ্বিতীয় কন্যা রাবেয়া খাতুনের সাথে আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। আমার শ্বশুর ছিলেন মল্লিকের বাড়ি সিনিয়র মাদ্রাসার সেক্রেটারী। আর আমার ওস্তাদ মাওলানা মূসা সাহেব ছিলেন এই মাদ্রাসার সুপার। আমার মাদ্রাসা জীবনের এই প্রথম ওস্তাদ আমাকে অস্বাভাবিক স্নেহ করতেন। তার সাথে আমার এই স্নেহ মমতার সম্পর্ক তার মৃত্যু পর্যন্ত বহাল ছিল। তারই আগ্রহে ও মধ্যস্ততায় আমার বিবাহ কাজ সম্পন্ন হয়।
আমি ও আমার স্ত্রী মোট ১১টি সন্তানের জনক ও জননী। এই ১১টি সন্তানের মধ্যে তিনটি কন্যা একেবারেই অপরিনত বয়সে মৃত্যু বরণ করে। বর্তমানে আমদের আট সন্তানের মধ্যে পাঁচ জন কন্যা ও তিনজন পুত্র। আমার সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হল নাসিমা খাতুন। ১৯৫৪ সনের মার্চ মাসে ফুলহাতা গ্রামে তার নানা বাড়িতে জন্ম গ্রহন করে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে তাকে যশোর জেলার নোয়াপাড়া নিবাসী মরহুম মাওলানা আব্দুল আজিজ সাহেবের ছোট ছেলে ডাক্তার আব্দুর রাজ্জাকের কাছে বিবাহ দেই। মরহুম মাওলান আব্দুল আজিজ দেওবন্দ মাদ্রাসা হতে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা আলেমে দ্বীন।
বিবাহের পরে নাসিমা খাতুন সৌদিআরবে চাকুরীরত তার স্বামীর সাথে সৌদিআরবে চলে যায়। সৌদিআরবে প্রায় বিশ বছর চাকুরী করার পর ডাঃ আব্দুর রাজ্জাক পরিবার পরিজনসহ দেশে প্রত্যাবর্তন করে। বর্তমানে তারা তাদের ধানমন্ডিস্থ ৩২ নং সড়কের বাড়িতে বসবাস করছে। আমার কন্যা নাসিমা খাতুন পাঁচটি পুত্র সন্তানের জননী। বড় ছেলেটি অসুস্থ বিধায় তেমন লেখা-পড়া শিখতে পারেনি। তবে বাকী চারজন খুবই মেধাবী ও প্রতিভাবান। মেঝ ছেলে জাবেদ ক্যানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় হতে গ্রাজুয়েশন করে এখন এম, এস, করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তৃতীয় ছেলে আরাফাত নিউইয়ার্কের ইয়োলো ইউনিভার্সিটিতে, উনিভার্সিটির ফুল স্কলারশীপে গ্রাজুয়েশান করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে খুবই মেধা সম্পন্ন ছেলে। চতুর্থ ছেলে হাছানুল বান্না গত বছর ‘এ’ লেবেল করে মালায়েশিয়ার কুয়ালালামপুর ইসলামি ইউনিভার্সিটিতে পড়া-শুনা করছে পঞ্চম ছেলে নাসিফ ‘ও’ লেবেল পরীক্ষা দিয়েছে। আল্লাহর রহমতে এরা সকলেই আদর্শ চরিত্রবান ও নামাজি। জামাতা ডাঃ আব্দুর রাজ্জাক একটি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনা করছেন।
আমার বড় ছেলে মাহবুবুর রহমান ১৯৫৮ সনে জানুয়ারীতে তার নানা বাড়ি ফুলহাতায় জন্ম গ্রহন করে। হিসাব বিভাগে মাস্টার্স করার পরে প্রথমতঃ খুলনা শহরে আমার ব্যবসা দেখাশুনা করত। আমার ব্যাবসা সংকোটিত করার পরে সে ঢাকাকে কেন্দ্র করে তার নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনা করছে। তাকে বিবাহ দেয়া হয় বাগেরহাট জেলার প্রসিদ্ধ গ্রাম সাইয়েদ মহল্লার সাইয়েদ আতাউল হকের বড় মেয়ে সাইয়েদা আতীয়া খাতুনের সাথে। সাইয়েদা আতাউল হক বাংলাদেশ ব্যাংকে দীর্ঘদিন চাকুরী করে ডি.জি.এম. হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন। আমার বড় ছেলে এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের পিতা। এরা দুজনই স্কুলের ছাত্র। একজন এস এস সি পরীক্ষা দিচ্ছে আর একজন ‘ও’ লেবেল দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুজনই মেধাবী।
আমার মেঝ মেয়ে হাছীনা খাতুন ১৯৬২ সনের সেপ্টেম্বর মাসে আমার খুলনার বাড়িতে জন্ম গ্রহন করে। তাকে বিবাহ দেয়া হয় বরিশাল শহরের অধিবাসী মরহুম হাছান খান সাহেবের বড় ছেলে ডাক্তার আব্দুল ওহাবের সাথে। মরহুম হাছান খান তখন বাংলাদেশ সরকারের রেভিনিউ মন্ত্রনালয়ের চাকুরী হতে অবসর গ্রহন করেছিলেন। যখন বিবাহ হয় তখন ডাক্তার আব্দুল ওহাব সৌদি সরকারের মিনিস্ট্রি অব হেলথে সরকারী ডাক্তার হিসাবে চাকুরী রত ছিল। বিবাহের বছরই হাছীনা খাতুন ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে জামাইয়ের সাথে সৌদি আরবে চলে যায়। আমার মেঝ মেয়ে এখন চার সন্তানেন জননী। বড় ছেলে মারুফ হাছান আমেরিকার কলগেট ইউনিভার্সিটি হতে গ্রাজুয়েশন করে ডাক্তারী পড়ার জন্য ডালাসের এক উনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে। তার দ্বিতীয় সন্তান একমাত্র মেয়ে রাদিয়া খাতুন এবং দ্বিতীয় পুত্র মুবাশ্বের হাছান ইংলিশ মিডেয়াম স্কুল হতে কৃতিত্বের সাথে ‘এ’ লেবেল পাশ করেছ এবং ঢাকার নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়া-শুনা করতেছে। ছোট ছেলে মাহের ধানমন্ডি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়তেছে। এরা সকলেই আল্লাহর রহমতে প্রতিভাবান ও মেধাবী। সকলেই চরিত্রবান ও নামাজী। আমার জামাতা ডাক্তার আব্দুল ওহাব সৌদী আরবে ২৫ বছর চাকুরী করার পরে এবার অব্যাহতি নিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। তারা ধানমন্ডির ১৪ নং রোডে তাদের নিজস্ব ফ্লাট বাড়িতে বসবাস করছে।
আমার মেঝ ছেলে মাসউদুর রহমান ১৯৬৪ সনের অক্টোবরে আমার খুলনার বাড়িতে জন্ম গ্রহন করে। সে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ হতে ইন্টামিডিয়েট পাশ করে বুয়েটে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হয়। এখান থেকে সে ব্যাচেলার করে আমেরিকার সাউথ ডেকোটা স্টেটের এক বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম এ করে আমেরিকার সর্ববৃহৎ টেলিভিশন কোং ইনটেলে চাকুরী গ্রহন করে। বর্তমানে সে ঐ কোম্পনীর রিজোনা স্টেটের কাখানায় ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কর্মরত আছে। তাকে বিবাহ করান হয় নোয়াখালি নিবাসী বর্তমানে ঢাকায় বসবাসরত জনাব এ, এইচ, এম, নূরুদ্দীন সাহেবের ছোট মেয়ে আসমা খাতুনের সাথে। জনাব নূরুদ্দীন সাহেব সি,এস,পি করার পরে প্রথমত জেদ্দা দূতাবাসে এবং পরবর্তিতে বাংলাদেশ আমলে কাবুল দুতাবাসের ফাষ্ট সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে পুনরায় সেক্রেটারিয়েটে বাংলাদেশ সরকারের অধীনে জয়েন্ট সেক্রেটারী হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি অবসর প্রাপ্ত। ধানন্ডিতে নিজের বাড়িতে বসবাস করছেন।
আমার মেজ ছেলে তিন সন্তানের পিতা। সবাই ছোট। প্রার্থমিক স্কুলে পড়া-শুনা করছে। মাসউদ অরিজোনা স্টেটে নিজস্ব বাড়িতে বসবাস করছে। সে এবং তার পরিবাররের সদস্যরা সকলেই এখন আমেরিকার নাগরিক।
আমার তৃতীয় কন্যা শামিমা নাসরিন যথাসম্ভব ১৯৬৬ সনের এপ্রিল মাসে আমার খুলান বাড়িতে জন্ম গ্রহন করে। অনার্সে পড়াকালীন অবস্থায় তাকে বিবাহ দেয়া হয় গোপালগঞ্জের, বর্তমান খুলনা শহরের বাসিন্দা জনাব ইসহাক (অবসরপ্রাপ্ত সহকারী পোসষ্ট মাষ্টা জেনারেল) সাহেবের বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার আশফাকুজ্জামনের কাছে। আশফাক বর্তমানে দুবাই সরকারের বিদ্যুৎ মন্ত্রনালয়ের অধিনে চাকুরী করছে এবং পরিবার নিয়ে দুবাই জাবাল আলীর সরকারী কোয়ার্টারে বসবাস করছে। আমর তৃতীয় কন্যা নাসরিন বিবাহের পরে মাষ্টার্স করেছে। সে তিন সন্তানের জননী। এক মেয়ে ও দুই ছেলে, এরা সব দুবাইয়ের প্রাথমিক স্কুলে পড়া-শুনা করছে।
আমার তৃতীয় ছেলে মাসফুকুর রহমান ১৯৬৯ সনের সেপ্টেম্বরে আমার খুলনার বাড়িতে জন্ম গ্রহন করে। আমি তাকে মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহন করার জন্য মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেই। দাখিল পরীক্ষা দেয়া পর্যন্ত সে মনোযোগ সহকারে পড়ে, দাখিল পরীক্ষায় ষ্টান্ড করেছিল। কিন্তু এরপর তার মাদ্রাসায় পড়ার আগ্রহ কমতে থাকে। সে বেশ মেধা সম্পন্ন এবং বিভিন্নমুখী প্রতিভার অধিকারী। ফাজেল পাশ করার পরে সে আমেরিকায় আমার মেঝ ছেলের ওখানে অস্টিনে চলে যায়। বর্তমানে সে অস্টিনে নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনা করছে। সে এখানে নিজস্ব বাড়িও করেছে। তাকে বিবাহ দেই খুলা শহরের অধিবাসী জনাব জাফর সাহেবের কন্যার সাথে। মাসফুক বর্তমানে এক কন্যা সন্তানের পিতা। এরা সবাই আমেরিকার নাগরিক হিসেবে আমরিকায় বসবাস করছে।
আমার চতুর্থ কন্যা সাইদা তানিয়া নাজনীন ১৯৭২ সনের ১৯শে মার্চ আমার খুলনা শহরে বাড়িতে জন্ম গ্রহন করে। তাকে বিবাহ দেয়া হয় খুলনা শহরের অধিবাসী মরহুম ডাক্তার মুহাম্মদ আলীর কনিষ্ঠ ছেলে ক্যাপ্টেন মেহদী বিল্লার কাছে। বিবাহের সময় সে অনার্সের ছাত্রী ছিল। পরে সে মাস্টার্স করেছে। মেহেদী বিল্লাহ সামুদ্রিক জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে বেশ কয়েকবছর চাকুরী করে শিপ হতে বিদায় নিয়ে দুবাই পোর্টে এক শিপিং কোম্পনীর অধীনে চাকুরী করছে। আমার চতুর্থ কন্যা দুই মেয়ে সন্তানের জননী। এরা দুবাইর প্রার্থমিক স্কুলে পড়াশুনা করতেছে।
আমার ছোট মেয়ে সনিয়া শারমিন জন্ম গ্রহন করে ১৯৭৫ সনের এপ্রিল মাসে আমর খুলনার বাড়িতে। তাকে বিবাহ দেয়া হয় রাজশাহী নিবাসী জনাব আব্দুল মান্নন সাহেবের দ্বিতীয় ছেলে গোলাম সরওয়ারের কাছে। বিবাহের সময় সনিয়া অনার্সের শেষ বর্ষে পড়ত। জামাই গোলাম সরওয়ার কুয়ালালামপুর ইসলামী উইনিভার্সিটি হতে বি,বি,এ করে আমেরিকা থেকে এম, বি, এ করে ওখানেই চাকুরী করছে। আমেরিকার ওয়াসিংটন স্টেটের সিয়টল শহরে নিজস্ব খরিদ করা বাড়িতে বসবাস করছে। তার ছোট্ট পরিবারের সকলেই আমেরিকার নাগরিক। বর্তমানে আমার ছোট মেয়ে দু’টি কন্যা সন্তানের জননী।
বর্তমানে আমার ও আমার স্ত্রীর নাতি-নাতনীর সংখ্যা ২২ )বাইশ)।
আল্লাহতায়লা তাদের সকলকেই অভাবমুক্ত রেখেছেন। বেকার কেউ নেই, সকলেই কর্মরত। আমার নাতি-নাতনীদের মধ্যে যারা বড় হয়েছে তারা সকলেই আদর্শ চরিত্রের অধিকারী। সকলেই নামাজী। আমার ছেলে মেয়ে, পুত্রবধু ও জামাতারা সকলেই নামাজি ও তাকওয়ার জীবন যাপনে অভ্যস্থ। মেয়েরা ও পুত্রবধুরা পর্দ্দা মেনে চলে আমার ছেলে মেয়ে ও নাতি-নাতনীরা (যারা বড়) ইসলামী জ্ঞান লাভ করার জন্য যেমন আগ্রহ সহকারে ইসলামী বই পত্র পড়া শুনা করে, তেমনি ইসলামী জ্ঞান চর্চার অনুষ্ঠানেও নিয়মিত যোগদান করে। আমার ছেলে-মেয়েদের অদিকাংশই ধানমন্ডি এলাকায় আমার বাড়ির কাছে বসবাস করায় তাদের সকলকে নিয়ে আমার বাড়িতে নিয়মিত পারিবাকি বৈঠক হয়। এ বৈঠকে কোরআন হাদীসের দরস ও পরিবাকিরক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
আমার সন্তান ও নাতি নাতনীদের আদর্শ জীবন গঠনে আমার চেয়ে আমার স্ত্রীর ভূমিকা মূখ্য। কেননা আমি তাদেরকে আমার স্ত্রীর মত সময় দিতে পিরিনাই। আর তাদের জন্য অত চিন্তা ভাবনাও করতে পরি নাই। যত করেছে আমার স্ত্রী। পরম করুনাময় আল্লাহ আমার ও আমার পরিবারের উপরে যে দয়া ও মেহেরবানী কেছেন তার জন্য মহান রব্বুল আলামিনের অজস্র শুকরিয়া আদায় করছি। আর নিয়ত তাঁর কাছে কামনা, তিনি যেন আমার পরিবার ও আওলদের উপরে তার এই করুনাধারা দুনিয়া ও আখেরাতে অব্যাহত রাখেন। আমিন, ছুম্মা আমিন।
আমার কর্ম ও রাজনৈতিক জীবনঃ
১৯৫০ সনে ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যায়নকালে আমি জামায়াতে ইসলাসমীর প্রতিষ্ঠাতা উপমহাদেশের বিশিষ্ঠ ইসলামী চিন্তা নায়ক সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রঃ) এর কয়েকখানা মূল্যবান বই পাঠ করে লেখক ও তাঁর ইসলামী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি।
১৯৫২ সনে আলীয়া মাদ্রাসা হতে সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করে আমি খুলনা শহরে অবস্থিত খুলনা আলীয়া মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। খুলনা আলীয়া মাদ্রাসায় কার্যরত অবস্থায় ১৯৫২ সনের যথাসম্ভব জুন মাসে আমি জামায়াতে ইসলামীর রুকন হয়ে রুকনিয়াতের শপথ গ্রহন করি। আমি ছিলাম বাংলাদেশীদের মধ্যে ২নং রুকন। ১নং রুকন ছিলেন মরহুম মাওলানা আব্দুর রহীম সাহেব। মাওলানা আব্দুর রহীম সাহেব যথাসম্ভব ১৯৪৬ সনে জামায়াতে ইসলামীর রুকন হন। বাংলা ভাষিদের মধ্যে তিনিই সর্ব প্রথম রুকন। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯৫৫ সনের চার্ম মাসে রুকন হন। মরহুম আব্দুল খালে সাহেব রুকন হন ১৯৫৩ সনে।
১৯৫৩ সনের প্রথমে আমি খুলনা আলীয়া মাদ্রাসা হতে বিদায় নিয়ে কিছু দিনের জন্য জামায়াতে ইসলামীর নির্দ্দেশে ঢাকায় আসি। তখন জামায়াতে ইসলামীর অফিস ছিল ২০৫ নং নওয়াবপুর রোডে। তখন পূর্ব পাকিস্তানের আমির ছিলেন পাঞ্জবের চৌধুরী আলী আহমদ। আর কাইয়েম অর্থাৎ জেনারেল সেক্রেটারী ছিলেন মাওলানা আব্দুর রহীম।
ঢাকায় আমার মূল কাজ ছিল জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশিত উর্দ্দু বইয়ের বাংলা অনুবাদ। প্রকাশ থাকে যে, ঐ সময় মাত্র দু’খানা পুস্তিকা বাংলায় অনুদিত ছিল। একখানা শান্তির পথ। আর একখানা ইসলামের জীবন পদ্ধতি।
বিভিন্ন কারণে আমি ঢাকা হতে বিদায় নিয়ে বরিশাল জেলার মঠবাড়িয়া থানার উপকন্ঠে অবস্থিত টিকিকাটা সিনিয়র মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষকের পদে যোগদান করি। এ মাদ্রাসায় আমি তিন বছরের মত সময় থাকি। অতঃপর জামায়াতে ইসলামী খুলনা বিভাগের আমীরের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে আমি জামায়াতের দির্দ্দেশে খুলনা শহরে চলে আসি।
আমার পশ্চিম পাকিস্তন সফরঃ
বিভাগীয় আমীরের দায়িত্বে নিয়োজিত হওয়ার পরে ১৯৫৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে নিখিল পাকিস্তান রুকন সম্মেলনে যোগদানের জন্য আমি সর্ব প্রথম পশ্চিম পাকিস্তান সফর করি। সম্মেলনের স্থান নির্ধারিত হয়েছিল পাঞ্জব প্রদেশের ভাওয়ালপুর স্টেটের মাচিগোট নামক স্থানে। সফর বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তান হতে আমরা মাত্র ১৪জন রুকন এই সম্মেলনে যোগদান করি। বাংলাভাষিদের মধ্যে মাওলানা আব্দুর রহীম, অধ্যাপক গোলাম আযম, জনাব আব্দুল খালেক, আব্বাস আলী খান ও আমি, এই পাঁচ জন ছিলাম। বাকীরা ছিলেন উর্দ্দুভাষী মুহাজির। এই সম্মেলন তিন দিন চলেছিল। সম্মেলন শেষে আমি সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় অবস্থিত পুরাতন সভ্যতার নিদর্শন ঐতিহাসিক ‘ময়েন যোদাড়ো’ দেখার জন্য শুক্কুর জেলার জামায়াত নেতাদের সাথে শুক্কুর শহরে চলে আসি। এখান থেকে একজন অভিজ্ঞ গাইড সাথে দিয়ে নেতারা আমাকে ‘ময়েন যোদাড়ো’ পাঠিয়ে দেন। পুরাতন সভ্যতার নিদর্শন দেখার আগ্রহ আমার স্বভাবজাত। সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তান রওয়ানা করার সময়ই আমি ময়েন যোদাড়ো সহ লাহোরে মোগল বাদশাদের স্মৃতি পূরাতন সভ্যতার নিদর্শন সমূহ দেখব বলে নিয়ত করেছিলাম। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার সে আগ্রহ এই সফরে কিছুটা হলেও পুরা হয়েছিল।
‘ময়েন যোদাড়োর‘ পরিচয়ঃ
সিন্ধি ভাষায় ‘ময়েন যোদাড়োর’ অর্থ হল ধ্বংস প্রাপ্ত মানুষের স্মৃতি। লারকানা জেলায় অবস্থিত এই পুরাতন শহরটি সিন্ধু নদ থেকে এক মাইল দূরে মাটি খুড়ে আবিষ্কার করা হয়েছে। প্রত্নতত্ববিদদের মতে ‘ময়েন যোদাড়ো’ যিশু খৃষ্টের জন্মের চার হাজার বছর আগের শহর। আমি যখন এটা পরিদর্শন করি তখন এক মাইল পর্যন্ত জায়গার মাটি সরিয়ে শহরের নিদর্শনসমূহ বের করা হয়েছে। আজ থেকে ছয় হাজার বছর আগের এই শহরটি বাড়ি ঘর, রাস্তা ড্রেন, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা দেখলে সত্যিই আশ্চার্য হতে হয়। শহরকে আবাসিক ও বাণিজ্যিক একলাকায় বিভক্ত করে বাড়ি-ঘর ও দোকান পাট নির্মান করা হয়েছিল। আজ থেকে তিন চারশো বছরের আগের মোগল ও পাঠাণ আমলের নির্মিত দালান কোঠার ইট ছোট ও পাতলা। কিন্তু ছয় হাজার বছর আগের তৈরী ময়েন যোদাড়োর দালান কোঠা ও রাস্তা ঘাট তৈরীর ইট আমাদের এই সময়ের ইটের মত ১০” x ৫” ইঞ্চি ছিল না। এখানে একটি যাদুঘরও করা হয়েছে। এখানে এই শহর থেকে সংগৃহিত ঐ সময়ের লৌহ নির্মিত অস্ত্র, তৈজষ পত্র, মহিলাদের সেই সময় ব্যবহৃত অলঙ্কারাদি ও সেই সময় ব্যাবহৃত নৌকা ও গরুর গাড়ির চাকাও দেখলাম।
আমাদের এক শ্রেণীর ঐতিহাসিকদের কথা ভুল প্রমাণীত হলঃ
আমরা ছোট বেলায় পড়েছি যে, আমাদের অনেক আগে ভারত বর্ষের লোকেরা অসভ্য ছিল। তারা ঘর-বাড়ি তৈরী করতে জানত না, গাছের খোপরে, পাহাড়ের গুহায় ও মাটির খোপরে বাস করত। রান্না বান্না জানতনা, কাঁচা মাছ মাংস ও ফলমূল খেত। কিন্তু ময়েন যোদাড়ো দেখার পর আমাদের ঐসব ঐতিহাসিকদের ধারণা ভিত্তিহীন বলে প্রমাণ হল। ‘ময়েন যোদাড়োর’ পরে ট্যাকসীলায় পুরাতন সভ্যতার নিদর্শন দেখার পরে আমার উপরোক্ত ধারণা আরও পাকা পোক্ত হয়েছে।
বিভাগীয় আমীর হিসাবে দায়িত্ব পালনঃ
আমি যখন বিভাগীয় আমীররের দায়িত্ব প্রাপ্ত হই, তখন খুলনা বিভাগে বৃহত্তর খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালী অন্তর্ভূক্ত ছিল। তখন বর্তমান জেলা সমূহ সাব-ডিভিশন ছিল। আমি যখন বিভাগীয় আমীর তখন পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা ইত্যাদি সহ বৃহত্তর বরিশাল জেলার আমীর ছিলেন মুফতী মাওলানা আব্দুস সাত্তার (সাবেক) এম.পি। বাগরেহাট, সাতক্ষীরা সহ বৃহত্তর খুলনা জেলার আমীর ছিলেন মাওলানা মীম ফজলুর রহমান। বৃহত্তর যশোর অর্থাৎ ঝিনাইদাহ,মাগুরা, ও নড়াইল সহ বৃহত্তর যশোর জেলার আমীর ছিলেন মাষ্টার আব্দুল ওয়াহেদ। বৃহত্তর ফরীদপুর ও কুষ্টিার আমীর ছিলেন মরহুম মাওলানা আব্দুল আলী। সাবেক এম,এন, এ জনাব শাসুর রহমান ছিলেন খুলনা বিভাগের জেনারেল সেক্রেটারী। এসময় পূর্ব পাকিস্তানে মোট বিভাগ ছিল চারটি। আর জেলা সংখ্যা ছিল মোট ১৯টি। ১৯৫৮ সনের ৮ই অক্টোবর আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক শাসন জারির আগ পর্যন্ত আমি ঐ দায়িত্ব পালন করতে থাকি। সামরিক শাসনের মাধ্যমে যেহেতু সমস্ত রাজনৈতিক ওদ ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকান্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাই আমি খুলনা আলীয়া মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষের অনুরোধে অধ্যক্ষ হিসাবে খুলনা আলীয়া মাদ্রাসায় যোগদান করি।
জাতীয় পরিষদে নির্বাচনে অংশ গ্রহনঃ
আইয়ুব খান সাহেব সামরিক শাসন বহাল রেখে তার প্রণীত শাসণতন্ত্র অনুসারে ১৯৬২ সনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন দেন। ভোটার ছিল ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বররা। আইয়ুব খান সাহেব এর নাম দিয়েছিলেন বি.ডি অর্থাৎ ব্যসিক ডেমোক্রাসী। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদকে তখন ১৫০ আসনে বিভক্ত করা হয়েছিল। ৭৫টি আসন পূর্ব পাকস্তিানের আর ৭৫টি পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগে আসে। আমাকে জামায়াতে ইসলামী খুলনা ও বরিশালের একটি জয়েন্ট সিট হতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বলে। কেননা এই নির্বাচনী এলাকাভুক্ত শরনখোলা থানায় আমার গ্রামের বাড়ী ছিল। ফলে আমি আলীয়া মাদ্রাসার চাকুরী হতে ইস্তেফা দিয়ে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশ গ্রহন করি। আমার নির্বাচনী এলাকা ছিল ৭টি থানার সমন্বয়। সাড়ে তিনটি খুলনা জেলায় আর সাড়ে তিনটি বরিশাল জেলায়। মাঝখানে সাড়ে তিন মাইল চড়ওড়া বলেশ্বর নদী। আমি এই এলাকায় ব্যাপক সংগঠনিক কাজ করে জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন কায়েম করেছিলাম। ফলে আমি বিপুল ভোটের ব্যাবধানে বিজয়ী হয়ে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হই। আমর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছিলেন দু’জন। একজন ছিলেন খুলনা জেলার অধিবাসী অধ্যাপক আব্দুর রহমান, (আওয়ামিলীগ) আর একজন ছিলেন বরিশাল জেলার অধিবাসী মোখতার আব্দুল গফুর। আব্দুল গফুর সাহেবের ধারণা ছিল যে, খুলনা হতে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতেছে, আর সে একা বরিশাল জেলা হতে প্রতিদ্বন্দী, ভোটার প্রায় সমান সমান। সুতরাং তিনি এককভাবে শুধু বরিশালের ভোট পেয়ে বিজয়ী হবেন। কিন্তু তার এ ধারনাকে ভুল প্রমাণ করে বরিশাল জেলার ভোটাররা আমাকে ব্যাপকবাবে সমর্থন দান কেরেন। আর খুলনা জেলার ভোট প্রায় এককভাবেই আমি পেয়েছিলাম।
জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন রাওলপিন্ডিরতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরিষদের বৈঠকে যোগ দিয়ে জানতে পারলাম যে, আমিই জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। আমার বয়স তখন পয়ত্রিশ বছর। জামায়াতে ইসলামী থেকে তখন আমরা ঐ পষিদে চারজন নির্বাচিত হয়েছিলাম। (১) মরহুম আব্বাস আলীখান (২) মরহুম শামসুর রহমান (৩) মরহুম ব্যরিস্টার আখাতরুদ্দিন এবং (৪) আমি। নেজামে ইসলাম হতে নির্বাচিত হয়েছিলেন চারজন ও জমিয়তে ওলামা হতে দুজন। আমাদের নেতাদের পরামর্শে ও আগ্রহে এই দশজনে, পার্লামেন্ট দশ সদস্য বিশিষ্ঠ পাপর্লামেন্টরী গ্রুপ গঠন করি। আমদের উদ্দেশ্য ছিল ন্যায় ও ইনসাফের পক্ষে পার্লামেন্টে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা। আল’হামদুলিল্লাহ পার্লামেন্টের এই পূর্ণ টর্মে আমরা উত্তমভাবে এ দায়িত্ব পালন করেছি।
আমার ব্যাপক পশ্চিম পাকিস্তান সফরঃ
জামায়াতে ইসলামীর সংগঠ যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র বিস্তারিত ছিল। তাই জাতীয় পরিষদের বৈঠকের বিরতির দিনে আমরা জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াতে রাওলপিন্ডির বাহিরে প্রগ্রামে যেতাম। ১৯৬৫সন পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের সদস্য থাকাকালিন এবং পরবর্তী পর্যায় পি.ডি.এম (পাকিস্তান ডেমোক্রাটিক মুভমেন্ট) এর কেন্দ্রী কমিটির সদস্য হওয়ায় আমি ব্যাপকভাবে জামায়াত ও পি.ডি.এম এর প্রগ্রামে পশ্চি পাকিস্তানের সর্বত্র সফর করেছি। পি,ডি,এম যেহেতু সম্মিলিত বিরোধী দলের একটি মোর্চা ছিল, তাই বিভিন্ন পার্টির নেতৃবৃন্দ মিলে আমরা একত্রেও সফর করেছি। একবার আমাদের সফর টিমে নেজামে ইসলামে নেতা সাবেক প্রধান মন্ত্রী চৌধুরী মুহাম্মদ আলী, আওয়ামিলীগ নেতা নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এ্যাডভোকেট শফিকুর রহমান প্রমুখ ছিলেন। এসব সফরে আমরা জনসভা, বুদ্ধিজীবী সম্মেলন ও প্রেস কনফারেন্সে বক্তব্য রেখেছি। দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত এভাবেই আমি ব্যাপকবাবে পশ্চি পাকিস্তান সফর করেছি।
প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খানের পদত্যাগ ও ইয়াহইয়া খানের ক্ষমতা গ্রহনঃ ১৯৭০ সনে প্রবল গণ আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহইয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেন। ইয়াহইয়া খান ক্ষমাতায় এসে এক পশ্চিম পাকিস্তানের জায়গায় সাবেক প্রাদেশিক কাঠামো বহাল করেন। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তান চারটি প্রদেশে ভিভক্ত হয়ে যায়। তিনি বিরোধী দল ও জনগণের দাবীর প্রেক্ষিতে বি,ডি (বেসিক ডেমোক্রাসি) সিস্টেম বাতিল করে জনগণের ভোটাধিকার বহাল করেন। অতঃপর ১৯৭০ সনের নির্বাচনে আঞ্চলিক পার্টি হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানে ভূট্টোর পিপলস পার্টি সংখাগরিষ্ঠতা লাবভ করে।
পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের প্রায় সব ছিট আওয়ামিলীগ দখল করে একক সংকাগরিষ্ঠ দল হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের পজিশান হাসিল করে। কিন্তু কেন্দ্রে পশ্চিম পকিস্তান ভিত্তিক সামরিক সরকার ক্ষমাতায় থাকায় সম্পূর্ণ অবৈধভাবে আওয়ামীলগিকে ক্ষমতা না দিয়ে ষড়যন্ত্রের পথ বাছাই করে নেয়। ফলে যে দুর্বিসহ অবস্থার সৃষ্টি হয, তাতে সশস্ত্র সংঘাতের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশ স্বতন্ত্র স্বাধীন দশে হিসাবে অস্তিত্ব লাভ করে।
পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীর দৃষ্টিভঙ্গিঃ
জামায়াতে ইসলামী এক দিকে যেমন ইসলামী আদর্শের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজ করছে, তেমনি ডিকটেটরী শাসন ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের ভিতরে ও বাহিরে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী পার্টিসমূহের সাথে মিলিতভাবে আন্দোলন করেছে। এর বিভিন্ন পর্যায় পি,ডি,এম (পাকিস্তান ডেমোক্রাটিক মুভমেন্ট), ডাক (ডেমোক্রাটিক একশান কমিটি) ইত্যাদি জোট, বিরোধী দল সমূহের সমন্বয় গঠিত হয়েছে। এ সব জোটে জামায়াতে ইসলামী সামিল থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার বিরুদ্ধেও জামায়াতে ইসলামী পার্লামেন্টের ভিতরে ও বাহিরে সমান সোচ্চার ছিল। তবে এ কথা স্বীকার করতে আমাদের কোন দ্বিধা নাই যে, মুসলিম জাহানের সর্ববৃহৎ দেশ পাকিস্তানকে অখন্ড রেখে অধিকার আদায়ের আমরা পক্ষপাতি ছিলাম। জামায়াত সহ সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রচেষ্টায় আমারা বাষট্টির পার্লামেন্টে প্যারিটি বিল পাশ করিয়ে চাকুরীবাকুরীসহ আর্থিক ও প্রশাসনিক বিষয়াদিতে পূর্ব পাকিস্তানে সমান অধিকার নিশ্চিত করেছিলাম। বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে আমরা মুসলমানদের সর্ব বৃহৎ দেশটাকে অখন্ড রেখে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের পক্ষপাতি ছিলাম। আর আওয়ামিলীগ সহ কতিপয় পার্টি বিভক্তির মাধ্যেমে অধিকার আদায়ের পক্ষপাতি ছিল। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে আমাদের সকলেরই লক্ষ এক ও অভিন্ন ছিল। তাছাড়া বিভক্তির ব্যাপারে ভারতের অত্যাধিক উৎসাহ এবং ৪৭ এর স্বাধীনতার পরপরই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ভারতের মুসলিম শাসিত দেশ হায়দারাবাদ ও জুনাগড় দখল করে নেয় এবং শক্তি বলে মুসলিম কাশ্মীরকে পদানত করার ঘটনা সমূহ আমাদের এই সন্দেহেকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। তবে বাস্তবে দেশ যখন বিভক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটল, তখন জামায়াতে ইসলামী স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মনে প্রাণে মেনে নিয়ে এ দেশ ও জনগণের কল্যাণের ব্রত নিয়ে দিবা-রাত্রি কাজ করে যাচ্ছে।
আমার গ্রেফতারী ও কারাবাসঃ
দেশ বিভাগের পরপর স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামিলীগ সরকার গঠন করে। আওয়ামিলীগ ক্ষমাতা গ্রহনের পর যেসব পার্টি অখন্ড দেশের পক্ষপাতি ছিল তাদের নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেয় এবং তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা দায়ের করে। অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে আমাকেও গ্রেফতার করে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান হয়। পরবর্তী পর্যায় আন্তর্জাতিক মহলের চাপে ১৯৭৩ সনের ডিসেম্বর মাসে পূর্ণ দু’বছর জেল খাটার পরে আমাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। আমি একাধারে দু’বছর জেলে থাকাকালীন আমার সন্তাদের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে আমার আপন ছোট ভাই ও আমার শরীকানা ব্যবসার অংশীদার রুহুল আমিন। রুহুল আমিন এখন খুলনা শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
জেলখানায় দু‘বছরঃ
জেলখানায় আমরা রাজবন্দী হিসেবে আইনতঃ প্রথম শ্রেণীর কয়েদী ছিলাম। ফলে আমাদের কিছু অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা ছিল। জেলখানার নূতন দালানের ডিভিশন প্রাপ্ত কয়েদীরা আমরা একত্রে জামায়াতে নামাজ আদায় করতাম এবং আমি দৈনিক নামাজ বাদ এক দিন কোরআনের দারস ও একদিন হাদীসের দারস দিতাম। এই দু’বছেরে কেন্দ্রীয় কারাগারের লাইব্রেরী হতে আমি ছোট বড় দুই’শতখানা বই পাঠ করেছি। আর এই জেলখানায় আমার দুখানা বই ‘মহাগ্রন্থ আল কোরআন কি ও কেন? এবং হাদীসের আলোকে মানব জীবন’ লেখা সমাপ্ত করি। হাদীসের আলোকে মানব জীবনের বাকী তিন খন্ড আমি জেল থেকে বের হওয়ার পরে লিখেছি।
আমার কারা জীবনের একটা ঘটনা লেখার লোভ আমি সংবরণ করতে পারছিনা। আমাদেরকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নেয়ার পরে আমার ক্যাবিনেট কলীগসহ চারজনকে একটি চার কক্ষ বিশিষ্ট জেলে আবদ্ধ করে রাখে। দিনে কক্ষের তালা খুলে দিলে কক্ষের বারান্দায় আমরা চারজন একত্রেই খানাপিনা খেতাম ও আলাপ আলোচনা করতাম। তখন সকলেরই ভিতরে চরম হতাশা ও পেরেশানী ছিল। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই কারা রক্ষীরা আমাদের স্ব-স্ব রুমে ঢুকিয়ে তালা লাগিয়ে দিত। আমার বন্ধু ও ক্যাবিনেট কলীগ মুহতারাম আব্বাস আলী খান আমার পার্শ্বের রুমেই ছিলেন। তিনিও বেশ হতাশ ও পেরেশান ছিলেন। বিশেষ করে নূতন সৃষ্ট বাংলাদেশে আর বোধ হয় ইসলামের নাম নেয়া যাবেনা বলে তিনি আমার কাছে বার বার বলছিলেন। আমিও বেশ বিচলিত ও পেরেশান ছিলাম। এ সময় রাত্রে জেলখানায় দেখা একটি খাব (স্বপ্ন) আমার হতাশা দূর করতে বেশ সাহায্য করেছে। আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, খাব বা স্বপ্ন শরীয়তের কোন দলিল নয়। তাই কোন স্বপ্ন দ্রষ্টাকে যদি শরীয়তর বিরুদ্ধে কোন কাজ করার নির্দ্দেশ স্বপ্নে দেয়া হয় তাহলে সে নির্দ্দেশ মানা যাবেনা। তবে উত্তম খাব নবুয়তের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ বলে আল্লাহর রসূল (সঃ) বলেছেন।
জেলখানায় এক রাতে চিন্তা-ভাবন করতে করতে আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি। হঠাৎ আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি লাহোরে মাওলানা মওদূদীর (রঃ) বাড়িতে। তিনি আমাদেরকে নিয়ে তার লাহোর শহরের বাড়িতে আছরের নামাজ আদায় করে বৈকালিক বৈঠকে নিত্য দিনের মত বসেছে। মাওলানা মওদূদী সাহেব চেয়ারে পশ্চিমমূখী হয়ে বসা ছিলেন। আর সকলে চেয়ারে মওদূদী সাহেবের দিকে মুখ করে বসেছেন। আমি বসার চেয়ার না পেয়ে মাওলানার দিকে পূর্বমূখী হয়ে দাড়িয়ে আছি। হঠাৎ আমি দেখতে পাই পূর্ব দিকের গেট হতে ছোরা হাতে একটা লোক মাওলানা মওদূদী সাহেবের দিকে সাবধানে অগ্রসর হচ্ছে। ইদ্দেশ্য তাকে হত্যা করা। যেহেতু আন্যেরা সবাই মওদূদী সাহেবের দিকে মুখ করে নীচু হয়ে কথা শুনছিলেন। তাই তারা এ দৃশ্য দেখতে ছিলনা। দাড়ান থাকার কারনে আমিই এই দৃশ্য দেখছিলাম। আমি মাওলানার জীবনের জন্য খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। হাঠাৎ দেখি আমার পার্শ্বে জালানী কাঠের স্তুপ। লোকটি মাওলানা মওদূদীর কাছে পৌছতেই তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করার আগেই আমি জালানি কাঠ নিয়ে জাম্প করে গিয়ে তাকে আঘাত দিয়ে ধরাশায়ী করে ফেলি। এই স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেংগে যায়। সকাল বেলা যখন সেলের তালা খুলে দেয়া হল, তখন আমি খুবই আশ্বস্থি সহকারে আব্বাস আলী খানকে খাবের বিবরণ শুনিয়ে বলি, আমি ইঙ্গিত পেয়েছি বাংলাদেশে ইসলামের কাজ আবার চলবে এবং ইসলামের শত্রুরা পরাভুত হবে।
আমার প্রথম হজ্জ্ব সফরঃ
জেলখানা হতে মুক্তি পাওয়ার দু’বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৫ সনে আমি প্রথমবারের মত হজ্জ্ব সফরে যাই। আমার হজ্জ্ব সফরের কথা শুনে খুলনার প্রায় আরও ত্রিশজনের মত হজ্জ্ব গমনেচ্ছু আমার সাথে একত্রে হজ্জ্ব করার জন্য কাফেলাভুক্ত হন। আল্লাহর মেহেরবানীতে কাফেলাভুক্ত হজ্জ্ব গমনেচ্ছুক আমরা একই বিমানে জেদ্দা অবতরণ করে রাত্রের প্রথম দিকে মক্কা শরীফ গিয়ে পৌছি।
অধ্যাপক গোলাম আযম তখন বাংলাদেশের নাগরিকত্বহীন অবস্থায় দেশের বাহিরে বসবাস করছিলেন। যথা সম্ভব তখন তিনি লন্ডন হতে হজ্জ্ব উপলক্ষে মক্কা শরীফ আসেন। আমাদের মক্কার বন্ধুরা আমাদের জন্য একটা বাড়ি ভাড়া করে রেখেছিলেন। যাতে হজ্জ্ব কালীন সময় একত্রে বসবাস করতে পারি। আমি, অধ্যাপক গোলাম আযম, আব্বাস আলী খান, সাবেক ছাত্র নেতা আবু নাসের, দুবাই থেকে আগত নূরুজ্জমান সাহেব সহ আরও কয়েকজন আমরা এই বাড়িতে উঠি। হজ্জ্ব সমাপ্তির পর দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত আমরা এই বাড়িতেই ছিলাম।
সাবেক পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রী সভায় আমাদের কলীগ এবং আমার বিশেষ বন্ধু ব্যারিস্টার আখতারুদ্দিন সাহেব তখন সৌদী এয়ার লাইনে লীগ্যাল এডভাইজার হিসাবে এয়ার লাইনের জেদ্দা অফিসে কর্মরত ছিলেন। তিনিও তার ফ্যামিলিসহ আমাদের সাথে হজ্জ্ব করার জন্য মিনার ক্যাম্পে এসে আমাদের তাবুতে স্থান নেন। আমরা ৯ই জিলহজ্জ্ব আরাফাত ও রাত্রে মুজদালিফায় অবস্থানের পরে আবার ১০ই জিলহজ্জ্ব মিনায় ফিরে আসি এবং যথারীতি কোরবানী করে মাথা কামিয়ে গোসল সেরে কেবল তাবুতে ফিরে আসি। ইতি মধ্যে অধিকাংশ লোক তাবুতে ফিরে এসেছে, এর মধ্যে দেখি আমাদের পার্শ্ববর্তী তাবুতে আগুন লেগে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমি কেবল তখন গোসল সেরে তাবুতে ফিরেছি। দেখি আমদের তাবুর সবাই তাবু ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমিও কাল বিলম্ব না করে হাতের কাছে আমার যে সামান পত্র পেয়েছি তাই নিয়ে জলদি তাবু ছেড়ে পাহাড়ে গিয়ে উঠলাম।
আগুন দাউ দাউ করে চতুর্দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। আর তাবুর পর-তাবু জলতে ছিল। ইতিমধ্যে মক্কা ও জেদ্দা হতে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি এসে আগুন নিভানোর চেষ্টায় ব্রতী হল। পার্শ্ববর্তী তাবুর খুটি সরিয়ে দড়ি কেটে তাবু মাটিতে ফেলে দেয়া হল। অত:পর কয়েক ঘন্টার চেষ্টার পরে আগুন নেভানো সম্ভব হল।
আমার সাথে তখন বিন হাবিব ছাড়া আর কেউ ছিলনা। আগুন যখন পুরাপুরি নিভানো হল তখন রাত হয়ে গিয়েছে। শীতের রাত্র, আমরা খুজা খুজি করে আমাদের ক্যাম্পের জায়গায় ফিরে আসলাম। আমরা দুপুরের খাবার খেতে পারিনি ফলে ক্ষুধায় খুব কাতর হয়ে পড়েছিলাম। অধিক রাত পর্যন্ত খুজাখুজি করে সবাইকে আবার একত্র করলাম। আল্লাহর রহমতে আমাদের সাথী হাজীদের কিছু ছামান পত্র পোড়া গেলেও সবাই জানে বেচে ছিলেন। আমার সাথী হাজীদের ফেরত পেয়ে আল্লাহর শুররীয়া আদায় করলাম।
পোড়া তাবুর হাজীদেরকে সৌদী সরকারের পক্ষ থেকে রাত্রের খানা ও কম্বল সরবরাহ করা হয়েছিল। কেননা তখন প্রচন্ড শীত ছিল। যে সব হাজীদের তাবু পুড়ে গিয়েছিল সৌদী সরকারের পক্ষ হতে পরে তাদেরকে এক হাজার রিয়াল করে ক্ষতিপুরণ দেয়া হয়েছিল। তাবুর মালিক মোয়াল্লেমদেরকে দেয়া হয়েছিল ক্ষতিপূরণ বাবদ মোটা অংকের টাকা। ফলে পোড়া যাওয়া তাবুর মোয়াল্লেমরা প্রচুর টাকা পেয়ে খুব খুশী হয়েছিল। আর পুড়ে যাওয়া তাবুর হাজীরাও এক হাজার করে রিয়াল পেয়ে খুশি ছিল। আমাদের তাবুর সবাই আমরা এক হাজার বিয়েল করে ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলাম। এ সফরে আমরা বাদশাহ ফাহদের বাড়িতে বাদশার সাক্ষাত ও তার দেয়া খানার অনুষ্ঠানে যোগ দেই। এ ছাড়া শেখ বিন বাজের সভাপতিত্বে রাবেতার এক আলোচনা সভা ও রাবেতার দেয়া খানার অনুষ্ঠানেও যোগদান করি। এই প্রথম সফরেই শেখ বিন বাজের সাথে কয়েকবার দেখা সাক্ষাত ও তার সাথে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়। তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তার মৃত্যু পর্যন্ত বহাল ছিল। তিনি ছিলেন সৌদী সরকারের রাজকীয় প্রধান মুফতী। অতপর মক্কা রিয়াদ ও তায়েফে যতবারই তার সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছে তিনি আমাকে তার বাড়িতে খানা না খাওয়ায়ে ছাড়েননি। তিনি একজন যুগশ্রেষ্ঠ খ্যাতনামা আলেমেদ্বীন যেমন ছিলেন, তেমনি তিনি ছিলেন বিশাল হৃদয়ের অধিকারী। তিনি সারা বিশ্বের মুসলমানদের সমস্যা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতেন। আল্লাহ তাঁর কবরকে নূর দ্বারা আলোকিত করুন, আর জান্নাতুল ফিরদাউসে তার স্থায়ী ঠিকানা করুন। আমীন।
এরপর আমি আল্লাহর মেহরবানীতে বহুবার হ্জ্জ্ব করেছি। কখনও রাবেতাতুল আলমে ইসলামীর মেহমান হিসেবে, কখনও সৌদী হ্জ্জ্ব মিনিষ্ট্রির মেহমান হিসেবে, কখনও জামায়াতে ইসলামীর ইজতেমায়ী হজ্জ্বের আমীরুল হজ্জ্ব হিসেবে। আমার হজ্জ্ব সফরের বিস্তারিত বিবরণ আমার লিখিত বই ‘দেশ হতে দেশান্তরের‘ মধ্যে বিশদভাবে এসেছে। আগ্রহী পাঠক ঐ বইখানা পড়ে দেখতে পারেন।
হযরত মাওলানা শামসূল হক ফরিদপুরীর (রঃ) সাথে তার গ্রামের বাড়িতে আমার ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারঃ
হযরত মাওলানা শামসূল হক সাহেব ছিলেন এ দেশের একজন খ্যাতনামা অনন্য চরিত্রের অধিকারী আলেমে দ্বীন। তিনি ওলামায়ে দেওবন্দের হালকায় শামিল থাকা সত্বেও সকল ধরনের ওলামা ও ইসলামপন্থীদের মহব্বত ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। এর মূলে ছিল তাঁর উদার মনোভাব। তিনি অত্যন্ত বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন এবং আমাকে খুবই মহব্বত করতেন। আমার জাতীয় পরিষদ সদস্য থাকাকালীন সময় (১৯৬২-১৯৬৫) ইসলামের পক্ষে জাতীয় পরিষদে আমার ভূমিকায় তিনি খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন এবং আমার জন্য দোয়া করতেন। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রঃ) ও জামায়াতে ইসলামীর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল হৃদ্যতাপূর্ণ। ইলমী আলোচনার মাধ্যমে চিন্তার ঐক্য ও ভুল বুঝাবুঝির অবসান কল্পে তিনি একাধিকবার তাঁর উপস্থিতিতে জামায়াতের নেতৃস্থানীয় আলেমদের সাথে দেওবন্দী হালকার আলেমদের আলোচনা বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই ধরনের একটা বৈঠকের ব্যবস্থা তাঁর ইনতেকালে কয়েক মাস আগে তাঁর গওহারডাঙ্গারস্থ বাড়িতে করেছিলেন।
হযরত মাওলানা (রঃ) তখন তাঁর গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। এমতাবস্থায় তাঁর একজন ভক্ত মুরীদ খুলনা শহরের অধিবাসী মাওলানা হাজী আহমদ আলীর দ্বারা তার সাথে সাক্ষাতের জন্য দুবার করে খবর দেয়ায় আমি বর্তমান ইত্তেহাদুল উম্মার মজলিসে সাদারতের সদস্য জনাব মাওলানা ফজলুর রহমানকে সাথে নিয়ে লঞ্চ যোগে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে খুলনা হতে গওহারডাঙ্গা মাদ্রাসায় পৌঁছি।
গওহারডাঙ্গা মাদ্রাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা আব্দুল আজিজ সাহেব চা-নাস্তার পরে আমাদের সহ ফরিদপুরী সাহেবের বাড়িতে আসেন। আমরা যখন হযরত মাওলানা শামসুল হক (রঃ) সাহেবের বাড়িতে সাক্ষাৎ করি তখন ছিল ১৯৬৮ সনের এপ্রিল মাস, এর পর আর তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন নি। এভাবেই রোগাগ্রস্তাবস্থায় ১৯৬৯ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারী তাঁর গ্রামের বাড়িতে তিনি ইন্তেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউ’ন) আমার সাথে স্বাক্ষাতের দশ মাস পর। আমার বাড়িতে পৌঁছার পরে তিনি কিতাবসহ মাদ্রাসা হতে কয়েকজন আলেমকে ডাকেন। অতঃপর উপস্থিত আলেমগণ হযরত মাওলানার নির্দেশে আমার সাথে মাওলানা মওদূদীর (রঃ) প্রনীত খেলাফত ও মুলুকিয়াত পুস্তক হতে হযরত আমীরে মুয়াবীয়া (রাঃ) সম্পর্কীয় কয়েকটি উক্তি পাঠ করে তারিখে ইবনে কাছিরের হওয়ালা (রেফারেন্স) দিয়ে মাওলানা মওদূদীর উক্তিকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। প্রকাশ থাকে যে, ঐ বৈঠকে যে দুটি বিষয় খেলাফত ও মুলুকিয়াতে লিখিত মাওলানা মওদূদীর উক্তিকে ভুল সাব্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল আমি তারিখে ইবনে কাছিরের মাধ্যমেই তার জওয়াব দিয়ে দেই। কেননা তারিখে ইবনে কাছিরেই মাওলানা মওদূদীর বক্তব্যের পক্ষে মজবুত দলিল ছিল।(দেখুন ‘খেলাফত ওয়া মুলুকিয়াত পার এ’তারাযাত কা ই’লমি যায়েজাহ’)
আলোচনার এক পর্যায়ে আমি উপস্থিত, ওলামায়ে কেরামের সামনে হযরত মাওলানা শামসুল হক (রঃ) সাহেবকে এ কথা বলেছিলাম যে আমি কামিল ক্লাশে হাদীস অধ্যানকালে ইসলামের ইতিহাস সবটাই পড়ার মোটামুটি চেষ্টা করেছি। দিল্লীর ‘নদওয়াতুল মুছাম্বেফীন’ কর্তক প্রকাশিত ‘তারিখে মিল্লাতের’ ছয়টি খন্ডই আমার কাছে আছে। এর ১ম দিকের কয়েকটি খন্ড (বনু উমাইয়াদের ইতিহাসসহ) লিখেন হযরত মাওলানা কাজী জয়নাল আবেদীন দেওবন্দী। আমার এ কথা বলার সাথে সাথেই হযরত মাওলানা শামসুল হক সাহেব মাওলানা জয়নাল আবেদীন হসাহেবের ভুয়সী প্রশংসা করেন ও বললেন, আমরা বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিষয় জানার জন্য দেওবন্দে তাঁর কাছে যেতাম। তিনি খুব বড় আলেম ও মোহক্কেক ছিলেন। হযরত ফরিদপুরীর কথা শেষ হতেই আমি বললাম, ইসলামের ইহতহাসে হযরত আলী (রাঃ) ও আমিরে মুয়াবিয়া (রাঃ) এর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ ও ঘটনা সমূহ পড়ার পরে উভয় মহান ব্যক্তিদ্বয়ের ব্যাপারে আমার মনে একটা ধারণা জন্মেছে এবং উভয়ের জন্য মনের মণি কোঠায় আলাদা আলাদা মর্যাদা নিরূপন হয়েছে। ‘খেলাফত ও মুলকিয়াত’ বই খানা পাঠ করার পরে ঐ ধারণার কোন পরিবর্তন হয়নি। কেননা ইসলামের ইতিহাস যারা লিখেছেন (আরব ঐতিহাসিক হোক কিংবা অনারব, কাজী জয়নাল আবেদীন দেওবন্দীসহ) তাদের থেকে ভিন্ন কোন কথা মাওলানা মওদূদী লিখেননি। এ কথা বলেই আমি আমার ব্যাগ হতে কাজী জয়নাল আবেদীন প্রনীত ‘তারিখে মিল্লাত’ বইখানা বের করে উহা হতে হযরত আমীর মুয়াবীয়ার (রঃ) প্রসঙ্গে লিখিত বিভিন্ন বিষয় তাঁর (কাজী জয়নাল আবেদীনের) কয়েকটি উক্তি পাঠ করে শুনালাম, যার ভাষা ছিল মাওলানা মওদূদীর ভাষা হতে কড়া ও মন্তব্য ছিল খেলাফত ও মুলুকীয়াতের মন্তব্য হতে কঠোর।(টীকাঃ ১) এর পর আমি উপস্থিত ওলামায়ে কেরামকে লক্ষ করে বল্লাম, হযরত আমিরে মুয়াবিয়ার (রাঃ) ব্যাপারে এত বড় কথা লেখার পরেও কেন মাওলানা কাজী জয়নাল আবেদীন দেওবন্দী ও তাঁর মত অন্যান্য ইসলামী ইতহাস লেখকদের বিরুদ্ধে কোন ফতওয়া দেয়া হচ্ছে না? অথচ তাঁদের চেয়ে নমনীয় ও মার্জিত কথা লিখেও মাওলানা মওদূদী (রঃ) ফতওয়ার শিকার হয়েছে। এর কারণ অনুসন্ধান করা দরকার। আমার মতে যেহেতু মাওলানা মওদূদী ইসলামী আন্দোলন করছেন সে জন্যই তাঁর লেখা চালনী দ্বারা ছাকা হচ্ছে এবং ত্রুটি বের করার বা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। হযরত মাওলানা কাজী জযনাল আবেদীনও যদি ইসলামী আন্দোলন করতেন তা হলে তাঁর লেখাও চালনী দ্বারী ছেকে ত্রুটি বের করার বা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হত। (টিকাঃ২)
অতঃপর আলোচনা বৈঠকে সাহাবায়ে কেরামের ‘মে’ইয়ার হক্ক’ অর্থাৎ সত্যের মাপকাঠি হওয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে আমি ব্যাগ হতে আমার লেখা বই জামায়াতে ইসলামীর বিরোধীতার অন্তরালে বের করে উহা হতে ছাহাবায়ে কেরামের ‘মে’ইয়ারে হক্ক’ সত্যের মাপকাঠি হওয়া না হওয়া প্রসঙ্গে চার মাজহাবের ইমাম সহ কতিপয় প্রসিদ্ধ ইমাম ও মোজাদ্দেদীনের উক্তি দলিল হস পেশ করে শুনিয়ে দেই।
সে বৈঠকে যে সব আলেমগণ উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে আমি মাওলানা আব্দুল আজিজ সাহেবকে চিনতাম। অন্য যারা ছিলেন নিঃসন্দেহে তারা গওহারডাঙ্গা মাদ্রাসার মত একটি বড় মাদ্রাসার সকলেই ওস্তাদ ছিলেন। এ সব ওলামায়ে কেরাম আমার কথা সেদিন মনের সাথে মেনে নিয়েছিলেন কিনা জানিনা, তবে আমার কথার ও যুক্তি প্রমাণের কোন প্রতিবাদও তারা করেন নি।
এরপর আমি বল্লাম, আমাদের আকীদা ও বিশ্বাস পয়গম্বরগণ ছাড়া আর সকল মানুষের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সে যত বড় আলেম বা পীরই হোকনা কেন। সুতরাং মাওলানা মওদূদী ছাহেবের ‘খেলাফত ও মুলুকিয়াত’ বইখানা আরও ভাল করে পড়ুন এবং যদি আপনাদের দৃষ্টিতে কোথাও ভুল পরিলক্ষিত হয় তাহলে দলিলসহ মাওলানা মওদূদী সাহেবকে লিখুন। আমি কয়েকদিনর মধ্যেই জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার বৈঠকে যোগদানের জন্য লাহোর যাচ্ছি। আমি সেখানে বেশ কয়েকদিন থাকব। আপনাদের লেখা টিঠি বা প্রশ্ন ওখানে খোঁজ করে বের করব। এবং মাওলানা মওদূদী সাহেবের নিকট হতে জওয়াব লিখে নিয়ে আসব। এরপর আমি লাহোরে যাই এবং সেখানে আমি বেশ কিছুদিন অবস্থান করি। কিন্তু অনেক খোঁজাখুজি করেও তাঁদের কোন চিঠিপত্র সেখানে পাইনি। এর ফলে আমি ধারণা করে নিয়েছিলাম যে আমার আলোচনার পর তাঁরা আর কোন প্রশ্ন করা দরকার মনে করেননি।
প্রকাশ থাকে যে আমার সাথে ঐ ইলমি আলোচনার মাত্র ১০ মাস পর হযরত মাওলানা শামসুল হক সাহেব ১৯৬৯ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে তাঁর গ্রামের বাড়িদত ইন্তেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন) (টীকাঃ ৩)
(টীকাঃ ১) (হযরত মাওলানা কাজী জয়নাল আবেদীন প্রণীত তারিখে মিল্লাত কিতাব খানা চকবাজারের লাইব্রেরীতে পাওয়া যায়)
(টীকাঃ ২) হযরত মাওলানা শামসুল হক সাহেব (রঃ) যেহেতু ইলমী আলোচনার জন্য মাঝে মধ্যে আমাদেরকে ডাকতেন। তাই খুলনায় আমাদের হাজী আহমদ আলী সাহেবের মাধ্যমে খবর দেয়ায় আমি ধারণা করেছিলাম যে হয়ত তিনি আমাকে আগের মতই কোন ইলমী আলোচনার জন্য ডেকেছেন। এই কথা ভেবে আমি ছোট আকারের কয়েকখানা কিতাব আমার ব্যাগে নিয়েছিলাম। তারিখে মিল্লাত কিতাখানাও ঐ কিতাব সমূহের মধ্যে ছিল। বড় কিতাব এ জন্য নেইনি যে বড় কিতাব ওখানকার মাদ্রাসা লাইব্রেরীতে ছিল। যে কিতাব ওখানে ছিলনা সে কিতাবই আমি সাথে নিয়েছিলাম। (টীকাঃ ৩) দেওবন্দসহ উপমহাদেশের যত দরসে নেজামী মাদ্রাসা আছে উহাতে ইসলামের ইতিহাস পড়ান হয়না। কেননা তাহাদের নেছাবে তারিখ শামিল নাই। তবে কোন কোন মাদ্রাসায় শুধু রাসূলের (সঃ) জীবনীটুকুই পড়ান হয়। এমতাবস্থায় তারিখে ইসলাম (খোলাফায়ে রাশেদীন, বনু উমাইয়া ও বনু আব্বাস) সম্পর্কে অনবিহিত এবস আলেমদের কাছে যখন তাদের বুজুর্গদের অভিযোগসহ হযরত আলী, হযরত হাছান (রাঃ) ও হযরত আমীরে মুয়াবিয়া ও ইয়াজিদ সম্পর্কীয় মাওলানা মওদূদীর লিখনী পেশ করা হয়, তখন তারা কোনরুপ তাহকীক ছাড়াই তাদের বড়দের মত সমর্থন করে থাকেন। অথচ মাওলানা মওদূদী (রঃ) ইসলামের বিজ্ঞ পুরাতন ঐতিহাসিকগণ হতে আলাদা কোন তথ্য বা মন্তব্য পেশ করেননি।
আমার তৃতীয়বার হজ্জ্ব সফরঃ
১৯৮৯ইং সালে হজ্জ্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে ১২ জুলাই বুধবার। এ দিনটি ছিল সৌদি আরবে ৯ জিলহজ্জ্ব আরাফায় অবস্থানের দিন। জুলাই মাসের তিন তারিখ সৌদি দূতাবাসের টেলিফোন পাই যে, আমাকে রাবেতাতুল আলমে ইসলামী এবারে হজ্জ্বে তাদের মেহমান করেছে এবং ভিসা পাঠিয়েছে। সুতারাং এখনই যেন আমি দূতাবাস থেকে ভিসা সংগ্রহ করে প্রস্তুতি নিয়ে পরের দিনই অর্থাৎ ৪ জুলাই পবিত্র হজ্জ্ব আদায়ের ইদ্দেশ্যে বাংলাদেশ বিমানে মক্কা শরীফের পথে দজিদ্দায় রওয়ানা হই। আমার সাথে আরও ছয়জন সঙ্গী ছিলেন। জিদ্দা বিমান বন্দরের যাবতীয় অনুষ্টানাদি শেষ করে বাইরে এসে দেখি ন্সেহেবর শহীদুল ইসলাম রাবেতার পত্রসহ আমাদেরকে নেয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছে। আমারা ঢাকা থেকে বাংলাদেশ সময় ৭টায় বিমানে রওয়ানা হই।
একটানা প্রায় ৭ ঘন্টা উড়ার পর বিমান সৌদি সময় প্রায় ১টায় জিদ্দা অবতরণ করে। এয়ারপোর্টের অনুষ্ঠানিকতায় বেশ সময় নেয়। অতঃপর আমরা যখন মক্কা শরীফে পৌঁছি তখন মাগরিব হতে কিছু বাকি। আমরা আসরের নামায দজিদ্দার পথে আদায় করে নিয়েছিলাম। যেহেতু আমরা সকলেই ক্লান্ত ছিলাম, তাই রাতে উমরা সমাপ্ত করা সম্ভব হয় নাই। ভোরে নাস্তা সেরে তওয়াফ ও ছাঈ করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর ঘরে হাজির হই। তওয়াফ ও ছাঈসহ উমরার আনুষ্ঠানাদি সেরে ঐ রাত শহীদুল ইসলামের বাসায় কাটাই। পরের দিন সকালে মিনায় রাবেতার গেস্ট হাইজে গিয়ে অভ্যর্থনা কক্ষে রিপোর্ট করি। অভ্যার্থনা কক্ষ হতে আমাকে থাকার জন্য রুম বরাদ্ধ করে চাবি, ব্যাজ ও খাবার টিকিট দিয়ে দেয়।
মিনায় মসজিদে খায়েফের সংলগ্ন একটি ৪ তলা বিশিষ্ট বিরাট দালানে রাবেতার মেহমানখানা অবস্থিত। এখানে নামায ও সম্মেলনের জন্য একটি বিরাট কক্ষ আছে। আমি পাঁচ বছর আগে আরও একবার সৌদি সরকারের মেহমান হয়ে হজ্জ্ব পালন উপলক্ষে এই মেহমানখানয় অবস্থান করেছিলাম। রাবেতার মেহমান হিসেবে ৭০টি দেশের প্রায় হাজার খানেক প্রতিনিধি এখানে হজ্জ্ব পালনের জন্য এসে সমবেত হয়েছিল। জিলহজ্জ্ব মাসের ৩ তারিখে আমি মেহমান খানায় প্রবেশ করি এবং বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে মতামত বিনিময় ও পরিচয় ইত্যাদি করতে থাকি।
একটানা প্রায় ৭ ঘন্টা উড়ার পর বিমান সৌদি সময় প্রায় ১ টায় জিদ্দা অবতরণ করে। হজ্জ্ব ইসলামের পঞ্চম রুকন। স্বচ্ছল মুসলমান তিনি দুনিয়ার যে অংশেই বাস করুন না কেন, জিন্দেগিতে একবার তার হজ্জ্ব আদায় করা ফরয। হ্জ্ব আদায় উপলক্ষে দুনিয়ার বহু দেশ হতে কয়েক লাখ মুসলমান নারী পুরুষ যখন মক্কায় সমবেত হয় তখন এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন ভাষারত, বিভিন্ন রংয়ের ও বিভিন্ন লেবাসের অগণিত, অজস্র লোকের সমাসেশ সত্যিই খুব আকর্ষণীয়। এসব লোকই আবার একই লেবাসে অর্থাৎ একখানা সাদা কাপড় পরিধান করে আর এখানা গায়ে জড়িয়ে লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক আওয়াজ তুলে যখন মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায় হাজির হয় তখন সে দৃশ্যের অবতারণ হয় তা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। কা’বা ঘরকে আল্লাহ তা’য়ালা বিশ্বের মুসলমানদের মিলন কেন্দ্র এবং হজ্জকে মিলন অনুষ্ঠান করে যে নির্দেশ দিয়েছেন তাতে অসংখ্য কল্যাণ নিহিত আছে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘যাতে করে প্রত্যক্ষ করতে পারে হজ্জ্ব যাত্রীরা তাদের উদ্দেশ্য নিহিত হজ্জ্বের কল্যাণ সমূহ’ (আল কোরআন)
দুনিয়ার বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন ভাষার ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের মুসলমানদের পরষ্পরের অবস্থা জানার ও উপলব্ধি করার এ এক মহা সুযোগ। রাবেতার মেহমান হওয়ার কারণে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের নেতৃস্থানীয় হজ্জ্ব প্রতিনিধিদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ, আলোচনার মাধ্যেমে আমি এই সুযোগের সদ্ব্যবহারের পুরামাত্রায় চেষ্টা করেছি। এ উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট লোকের সাথে আমার আলোচনার বিবরণ আমার লিখিত বই ‘দেশ হতে দেশান্তরের ভিতরে দেয়া হয়েছে। তবে এখানে বাদশাহ ফাহদের মিনার বাড়ির অনুষ্ঠানে যোগদানের বিষয়টি কেবলমাত্র দেয়া হল।
১১ জিলহজ্জ্ব বাদশাহ ফাহদের বাড়ির অনুষ্ঠানে যোগদানঃ
১০ জিলহজ্জ্ব বিকেলে রাবেতার একজন কর্মচারী এসে খবর দিল, ‘আগামীকাল সকাল সাড়ে সাতটায় মহামান্য বাদশাহ ফাহদের বাড়িতে এক অনুষ্ঠান হবে। উক্ত অনুষ্ঠানে যারা আমন্ত্রিত তাদের মধ্যে আপনিও আছেন। সুতরাং আপনি প্রস্তত হয়ে সময়ের পূর্বেই অভ্যর্থনা কক্ষে হাজির হবেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, হাজার-খানেক প্রতিনিধির মধ্য হতে মাত্র ৩৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে বাছাই করে আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। আমরা সময়মত অভ্যর্থনা কক্ষে হাজির হলে পরে কয়েকখানা গাড়িতে করে আমাদেরকে বাদশার মিনায় অবস্থিত বিরাট বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েকটি গেট পার হয়ে আমরা বাদশার বাড়ির বিরাট কনফারেন্স কক্ষে গিয়ে হাজির হই। রাবেতার আমন্ত্রিত মেহমান ছাড়াও হজ্জ্ব মন্ত্রলালয় ও বাদশার মেহমানসহ আমরা মোট দু’শ মেহমান ওখানে উপস্থিত হই। আমন্ত্রিতদের মধ্যে কয়েকটি দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্র প্রধান ও রাজপ্রতিনিধিরাও ছিলেন। আফগানিস্তানের মুহাজিদ সরকারের প্রধান সেবগাতুল্লাহ মোজাদ্দেদীও বাদশার পাশে রাষ্ট্র প্রধানদের সারিতে উপবিষ্ট ছিলেন। বাদশাহ ফাহাদ অনুষ্ঠানে এসে আসন গ্রহণ করার পর পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে কার্যক্রম শুরু হয়। অতঃপর পর্যায়ক্রমে রাবেতার সেক্রেটারী জেনারেল আবদুল্লাহ নাসিফ, হজ্জ্ব মন্ত্রী এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের মুফতি সাহেবান মেহমানদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। সব শেষে পবিত্র হারাম শরীফদ্বয়ের খাদিম মহামান্য বাদশাহ ফাহদ বিন আব্দুল আজিজ সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট হজ্জ্ব প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে এক দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। এতে তিনি মুসলিম বিশ্বের প্রধান প্রধান সমস্যা যেমন ফিলিস্তিন সমস্যা, আফগানিস্তানের স্বাধীনতার জিহাদ, ইরান-ইরাক যুদ্ধ ইত্যাদির উপরে সৌদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেন।
বাদশার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর তিনি এক এক করে সকল মেহমানের সাথে করমর্দন করেন এবং পরিচয় নেন। এখানের অনুষ্ঠান শেষ হলে আমাদেরকে বৃহদাকার খাওয়ার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। খাওয়ার কক্ষে এক অদ্ভুত কান্ড। সারিবদ্ধ বিরাট টেবিলে মাঝখানে বৃহদাকার খাঞ্চার উপরে পোলাও রেখে তার উপরে একটি রোস্ট করা আস্ত দুম্বা বসিয়ে রেখেছে। চার চার জনের জন্য এধরনের একটি খাঞ্চা ছাড়াও প্রচুর কাবাব, মিষ্টি ও ফলমূল প্লেটে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। অনুমানিক এ ধরনের শ’তিনেক খাঞ্জায় তিনশ আস্ত ভাজি করা দুম্বা, পোলাও, বিরিয়ানী ও নানা ধরনের উপাদেয় খাদ্য সম্ভারে এক দশমাংশ খাওয়াও আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। জানিনা এর পর আর কোন মেহমান এসব খাবার খাবে কিনা? খানার অনুষ্ঠান শেষে আমরা আবার আমাদের নির্দিষ্ট মেহমানখানায় ফিরে আসি। ১৫ জিলহজ্জ্ব পর্যন্ত আমি রাবেতার মেহমানখানায় বিভিন্ন দেশের হাজিদের সাথে মত বিনিময় ও দেখা সাক্ষাৎ করে কাটাই। অতঃপর মক্কা শরীফে এসে বিদায়ী তওয়াফ সমাধা করে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে জিদ্দা রওয়ানা হই।
হারামে বোমা বিষ্ফোরণঃ
সবশেষে একটি বিষয় আলোচনা করা প্রয়োজন বোধ করছি। তা হলো হারাম শরীফে বোমা বিষ্ফোরণের বিষয়। ৭ জিলহজ্জ্ব দুটি এবং ১০ জিলহজ্জ্ব একটি এই মোট তিনটি বোমা পবিত্র হারাম শরীফে বিষ্ফোরিত হয়। যাতে একজন হাজি মুত্যুবরণ করেন।এবং বেশ কতিপয় হাজী আহত হন। মহান আল্লাহ পবিত্র কা’বা ঘর এবং তার পার্শ্ববর্তী নির্দিষ্ট এলাকাকে হারাম হিসেবে ঘোষণা করে এখানে সব রকমের রক্তপাত, খুন-খারাবীকে কিয়ামত পর্যন্ত হারাম করে দিয়েছেন। অবহমানকাল হতে এমনকি জাহেলিয়াত যুগেও আরবরা এ নিয়ম নিষ্ঠা সহকারে মেনে চলেছে। সুতরাং যিনি বা যারা এ ধরনের একটি মারাত্মক অপরাধের কাজ হারাম শরীফের সীমানায় করল সমগ্র মুসলিম উম্মাহর তারা ঘৃণার পাত্র। আশা করি সৌদি সরকার অপরাধীদেরকে খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি দানে হারামের পবিত্রতা নিশ্চিত করবেন। ( বোমা হামলার এসব অপরাধীদেরকে পরে সৌদি পুলিশ পাকড়াও করে এবং বিচারে তাদের সকলের শিরোচ্ছেদ হয়, এরা ছিল কুয়েতি শিয়া।)
আমার প্রথম গ্রেট ব্রিটেন সফরঃ
আমি এবং মাওলানা দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদী ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে অনুষ্ঠিতব্য সিরাত কনফারেন্সের দাওয়াতে ১৯৭৮ সনে প্রথমবার গ্রেট ব্রিটেন সফরে যাই। এই সম্মেলন উই,কে ইসলাম মিশন ও দাওয়াতুল ইসলাম গ্রেট ব্রিটেনের যৌথ উুদ্দ্যগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ সম্মেলনে পাকিস্তান ও ইন্ডিয়ার কয়েকজন খ্যাতনামা আলেম যোগদান করেছিলেন। সম্মেলন সমাপ্তিতে আমরা উপরোক্ত সংগঠনের উদ্দ্যগে গৃহিত প্রোগ্রামে সারা গ্রেট-ব্রিটেনে প্রায় এক মাস সফর করি।
এ পুরা সফরে আমরা দুজন অর্থাৎ আমি এবং সাঈদী সাহেব একত্রে ছিলাম। সাঈদী সাহেব একজন ভাল মানের ওয়ায়েজ ও মোফাচ্ছির। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের বাইরে খুবই প্রসিদ্ধ। সাঈদী সাহেব আমার ছাত্র্ তিনি খুলনা আলীয়া মাদ্রাসায় ফাজেল ক্লাসে পড়াকালীন আমার ছাত্র ছিলেন। (যথা সম্ভব ১৯৬০,৬১ সনে) তখন আমি খুলনা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। সাইদী সাহেবের পিতার সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্ক ছিল। ফলে সাইদী সাহেব (আল্লাহ তাকে আরও অধিকতর ইসলাম ও জাতির খেদমত করার তৌফিক দান করুক)। আমাকে পিতার মতই ভক্তি শ্রদ্ধা করেন। আর আমিও তাকে পুত্রবৎ স্নেহ করি। তার পরিবারের সাথেও আমার পরিবারের সম্পর্ক খুবই নীবিড়। গ্রেট ব্রিটেনে একমাসকাল সফরের পরে আমরা দেশে ফিরে আসি। আমাদের সফরের শেষের দিকে অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব লন্ডনে আমাদের সাথে মিলিত হন। কায়েকমাস তিনি লন্ডনে থেকে এ বৎসরই বাংলাদেশের নাগরিকত্বহীন আযম সাহেব জিয়া সরকারের বিশেষ অনুমতিতে অসুস্থ মাকে দেখার জন্য ১৯৭৮ সনে বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর হাইকোর্ট থেকে তার নাগরিকত্ব বহালের আগ পর্যন্ত তিনি আর দেশের বাহিরে যাননি। যদিও সরকার কয়েকবার তাকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন।
১৯৮২ সালে পাকিস্তানে আমার দীর্ঘ সফরঃ
দেশ বিভক্তি হওয়ার পূর্বে আমি অসংখ্যবার পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সীমান্ত, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের বহু জায়গা সফর করেছি। যেহেতু তখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একদেশ ছিল এবং ভিসার প্রয়োজন ছিল না। উপরন্ত পূর্ব ও পশ্চি পাকিস্তানের মধ্যে সহজ যাতায়াতের উদ্দেশ্যে বিমান ভাড়ায় সাবসিডি দেয়া হত, তাই সফর মোটামুটি কম ব্যয়বহুল ছিল। তাছাড়া আমি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ও পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শুরার সদস্য হওয়ার কারণে পরিষদ ও শুরার অধিবেশনে যোগাদানের জন্যও আমাকে বছরে কয়েকবার করে পশ্চিম পাকিস্তান যেতে হতো। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন চলাকালীন কখনও কখনও মাসাধিককাল রাওলপিন্ডিতে অবস্তান করতে হতো। এসব সফরের আগে পরে এবং বিরতির দিনে পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে প্রধান প্রদান শহরে প্রগ্রাম করেছি। মুহতারাম ভাই আব্বাস আলী খান ও শামসুর রহমান সাহেবনদ্বয়ও জাতীয় পরিষদ সদস্য ছিলেন বিধায় অনেক ক্ষেত্রে আমরা যৌথভাবে প্রগ্রাম করেছি। কিন্তু দেশ বিভক্তি হওয়ার পরে আর ঐভাবে সফর সম্ভব ছিল না। কেননা এক দেশ এখন স্বতন্ত্র দু’টি স্বাধীন দেশে পরিণত হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ সৃষ্টির পরে সর্বপ্রথম আমি ১৯৭৮ সালে ভিসা নিয়ে পাকিস্তান সফর করি। অতঃপর বেশ কয়েকবারই আমি পাকিস্তান সফর করেছি। বিশেষ করে আফগানিস্তানে সশস্ত্র জিহাদ শুর হওয়ার পরে যুদ্ধের প্রকৃতি অবস্থা জানার জন্য আমি একাধিকবার পাক-আফগান সীমান্তে মুজাহিদ নেতাদের সাথে সাক্ষাত করে তথ্য সংগ্রহ করেছি। এসব সফরেও জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের পুরাতন বন্ধুরা পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে আমাকে দিয়ে প্রগ্রাম করিয়েছেন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকা আমার সাক্ষাতকারও গ্রহণ করেছে। তবে পত্রিকায় প্রকাশিত ১৯৭৮ সনের সফর বিবরণ হারিয়ে যাওয়ায় ১৯৮২ সালের সফর বিবরণ পুস্তকে দেয়া হল।
১৯৮২ সালে পাকিস্তানে আমার দীর্ঘ সফরঃ
১৯৮২ সালে আমি করাচী হতে শুরু করে সওয়াত পর্যন্ত দুই সপ্তাহেরও অধিককাল ধরে এক দীর্ঘ সফর করি। এ পুরা সফরেই আমার সাথী ছিলেন করাচী হতে নির্বাচিত পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আমার পুরাতন বন্ধু এককালের খুলনার অধিবাসী জনাব আসগর ইমাম। করাচী হতে আমরা লাহোর পর্যন্ত ট্রেনে সফর করেছিলাম। অতঃপর ২৪শে এপ্রিল জোহর নামায বাদ প্রাইভেট কারে দীর্ঘ সফরের উদ্দেশ্যে রাওয়ালপিন্ডি রওয়ানা হই। রাওয়ালপিন্ডিতে মেজবান হোটেলে বন্ধুরা আমাদে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা সাক্ষাত ও বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গা দেখে পরের দিন কিবালে মারী রওয়ানা হয়ে মাগরিবের সময় গিয়ে মারী হাজির হই। রাওয়ালপিন্ডি হতে মারীর দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। মারী শহরটি সাড়ে সাত হাজার ফিট উঁচুতে একটি শৈল নিবাস। শীতের সময় এখানে প্রচুর তুষারপাত হয়। পাহাড়ী রাস্তায় নীচে থেকে উঁচুতে চড়তে এবং বর্ষায় রাস্তা ভিজা থাকার কারণে আমাদের গাড়ি খুব আস্তে আস্তে চলছিল। মারীতে আমরা মারী জামায়াতে ইসলামীর আমীর এহভোকেট রাজা ইমতিয়াজের বাড়িতে মেহমান ছিলাম।(১) গুঁড়ি গুঁড়ি বর্ষায় রাত্রে মারীতে এপ্রিল মাসের শেষে অস্বাভাবিক শীত ছিল।
রাত্রে আমরা আমাদের জামা-সোয়েটারসহ চার চাটি কম্বল গায়ে দিয়েও শীত ঠেকাতেপারছিলামনা। ভোরে নামাজান্তে নাস্তা ইত্যাদি সেরে আটটার দিকে আমরা পাহাড়ি রাস্তা ধরে আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী মোযাফফারাবাদ রওয়ানা হই। মারী হতে মোযাফফারাবাদ শহরের দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার মাত্র। কিন্তু পাহাড়ী রাস্তার চড়াই উৎড়াই অতিক্রম করে এই ৫৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে আমাদের প্রায় ৪ ঘন্টা সময় লেগেছিল।
আযাদ কাশ্মীর জামায়াতের আমীর কর্ণেল রশীদ আব্বাসী এখানে আমাদেরকে শহরের প্রবেশদ্বারে অভ্যার্থনা জানান। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সরকারী রেষ্ট হাউজে। এ দিন বিকালে আমরা ঝিলম নদীর পারে বাদশাহ আকবরের তৈরী দুর্গ দেখতে যাই। মাগরিব বাদ রেষ্ট হাউজে ফিরে আসি। এই রাত্রে খুব বর্ষা হচ্ছিল বিধায় শহরে বের হওয়া সম্ভব ছিল না, ভোরে নাস্তা সেরে কর্ণেল আব্বাসীসহ শহর হতে পাঁচ মাইল দূরে লোহারী গেট ভিউ পয়েন্টে গিয়ে মোযাজ্জারাবাদ শহরের দৃশ্য অবলোকন করি। মাগরিব বাদ আমাদের উদ্দেশ্যে দেয়া এক অভ্যার্থনা সভায় যোগদান করি। পরের দিন ২৮ এপ্রিল ভোরে নাস্তা সেরে আমরা এবাটবাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ধীর গতিতে ২২ কিলোমিটার পাহাড়ী রাস্তা অতিক্রম করে গাড্ডি হাবিবুল্লাহ নামক স্থানে আমরা কুনহার নদী পার হই।
কুনহার নদী হিমালয় হতে প্রবাহিত হয়ে কাগন ভেলী হয়ে ঝিলামের সাথে মিলিত হয়েছে। এই নদীর পারে বালাকোট নামক স্থানে সাইয়েদ আহম্মদ শহীদ ও শাহ ইসমাইল শহীদ শীখদের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। এই স্থানটিতে আমরা ১৯৬২ সালে সফর করেছি। গাড্ডি হাবিবুল্লাহ হতে বালাকোটের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। যুদ্ধ শেষে সাইয়েদ শহীদের সাথীরা সাইয়েদ শহীদের মস্তক বিহীন দেহ বালাকোটে দাফন করেন। পরে খোঁজাখুঁজি করে গাড্ডি হাববিুল্লাহ কুনহার নদীতে সাইয়েদ শহীদের ছিন্ন মস্তক পেয়ে তাঁর সাথীরা ওখা্ই তাঁর মস্তক দাফন করেন। কুনহার নদীটি খুবই খরস্রোতা। বালাকোটে শিখেরা যখন অতর্কিত আক্রমণ করেছিল। তখন সাইয়েদ সাহেব ও তাঁর সাথীরা অপ্রস্তুত ছিলেন। প্রকাশ থাকে যে, এক মসুলম বিশ্বাসঘাতক শিখ বাহিনীকে সাইয়েদ সাহেবের অবস্থানের খবর দিয়ে গোপন আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করেছিল। ইতিহাস সাক্ষী মুসলমানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুসলিম নামধারী স্বার্থপর মীল জাফররাই মুসলমানদের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছি।
মোযাফফরাবাদ থেকে রওয়ানা হয়ে ৫২ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে বেলা ১১টার দিকে আমরা মানসেরা ফৌঁছি। মানসেরা হতে গিলগিট হয়ে রেশমী রোড চায়না চলে গিয়েছে। এই রোড তৈরির পর স্থল পথে চায়নার সাথে পাকিস্তানের যোগাযোগ ব্যবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে।
আমাদের রাত্রের প্রগ্রাম এবং অবস্থান ছিল এবাটাবাদে , সেখানে লাহোর হতে আগেওভাগেই খাবর দেয়া হয়েছিল। মানসেরায় আমাদের কোন প্রগ্রাম ছিল না। বিধায় পূর্বাহ্নেই কোন খবর দেয়া হয়নি। কিন্তু মাসেরা হতে চুপচাপ পুরান বন্ধুদের সাথে দেখা না করে চলে যাব এটা আমার মন মানল না। তাই জামায়াত নেতা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য এডভোকেট শওকাত সাহেবের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বার লাইব্রেরীতে গিয়ে হাজির হই। এধরনের অপ্রত্যাশিত আগমনে শওকাত সাহেব যেমন আশ্চার্য হয়েছিলেন, তেমনি বেশ খুশীও হয়েছিলেন। এখানে আমার এক কালের জাতীয় পরিষদের সাথী সদস্য, প্রাক্তন মন্ত্রী হানিফ খানের সাক্ষাত পাই। তিনি ও শওকাত সাহেব উভয়ই অন্ততঃ একদিন মানসেরায় অবস্থানের জন্য আমাকে বেশ অনুরোধ করতে থাকেন। কিন্তু রাত্রে আমার প্রগ্রাম এবাটাবাদে থাকার কারণে বন্ধদের অনুরোধ রক্ষায় অপারগ বলে জানাই। শওকাত সাহেব আমাদেরকে নিয়ে শহরে তার বড়িতে আসেন। এখানেই আমরা উপস্থিত মত দুপুরের খানা খেয়ে জামায়াত অফিসে চলে আসি। শওকাত সাহেব স্বল্প সময়ের নোটিশে তড়িগড়ি করে জামায়াত কর্মীদের এক সম্মেলনের ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে আমি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখার পরে বন্ধুদের প্রশ্নের জওয়াব দান করে চা পর্ব শেষ করে এবোটাবাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। বাংলাদেশ সৃষ্টির পরে বাংলাদেশের আর কোন জামায়াত নেতাকে এভাবে বন্ধুরা পাননি, ফলে বাঙলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও আর্থিক অবস্থা ইসলামী আন্দোলনের অবস্থা, ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণের মনোভাব ইত্যাদি আমার কাছ থেকে জানার জন্য সর্বত্রই বন্ধুরা আগ্রহশীল ছিলেন।
*(১) টীকাঃ
এ্যাডভোকেট রাজা ইমতিয়াজ একজন ধনী লোক। ইনি আমার পুরাতন বন্ধু, রাজা সাহেবের পিতার বাড়ি রাওয়ালপিন্ডি। মারী ও মারী হতে ১৫ মাইল উত্তরে সুরাসি নামক স্থানেও ২ খানা বাড়ি আছে। আমি, আব্বাস আলী খান, শামসুর রহমান সাহেব ও ব্যারিষ্টার আখতারুদ্দীন ১৯৬৩ সালে জাতীয় পরিষদের সেশন চলাকালে মাসাধিককাল তাদের রাওলপিন্ডির বাড়িতে ছিলাম। ঐ বছরই আমরা তার পাহাড়ের উপরে অবস্থিত সুরাসি গ্রামের বাড়িতে বেড়িয়েছি। ইমতিয়াজ সাহেবের পিতা ছিলেন বেশ কয়েকটি পাহাড়ের মালিক একজন জমিদার।
এবোটাবাদে আমার রাত্রে অবস্থান ও প্রগ্রামে অংশগ্রহণঃ
মানসেরার অনুষ্ঠান সেরে আমরা এবোটাবাদ রওয়ানা হই। মানসেরা হতে একজন সাথীকে আমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য দেয়া হয়েছিল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি এবোটাবাদ শহর হতে কয়েকমাইল দূরে অবস্থিত সাবেক পি,ডি,পি নেতা আব্দুর রউফ জাদোনের নীলম গ্রামের বাড়ি চিনেন কিনা? ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মুহাম্মদ আলী, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ, জনাব ফরিদ আহম্মদ ও মাহমুদ আলী সাহেবসহ আমরা বেশ কতিপয় বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনের সময় এবোটাবাদে জনসভা করে রাত্রে পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত জাদোনের বাড়িতে ছিলাম, নানা সরকারী নির্দেশে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য কোন রেস্ট হাউজ বরাদ্দ করতে অপারগতা প্রদর্শন করেছিলেন। ফলে আমরা সকলেই আব্দুর রউফ জাদোনের বাড়িতে রাত্রি যাপন করেছিলাম। আমাদের গাইড বলল, জি হ্যা, আমি জাদোনের বাড়ি চিনি। আমরা তখন মেইন রোড থেকে নেমে জাদোনের বাড়ির দিকের রাস্তা ধরে তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। প্রায় চৌদ্দ বছর পর কোন পূর্ব সংকেত ব্যতীত আমাকে তার বাড়িতে পেয়ে সে যেন আসমান থেকে পড়ল। কুশল বিনিময় ও চা নাস্তার পরে আমি রওয়ানা হতে চাইলে তিনি কিছুতেই ছাড়তে রাজী ছিলেন না, কিন্তু যেহেতু মাগরিব বাদ এবোটাবাদে আমার পূর্ব নির্ধারিত প্রগ্রাম ছিল, তাই তাকে রাজি করিয়ে রওয়ানা হয়ে এবোটাবাদ এসে হাজির হই।
হাজারা জেলার হেডকোয়ার্টার এবোটাবাদ শহর সমুদ্র লেবেল হতে প্রায় সাড়ে চার হাজার ফিট উঁচুতে পাহাড় ঘেরা একটি উপত্যকা। মারী হতে এখানে শীতের প্রকোপ একটু কম। এখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা একটি আবাসিক হোটেলে করা হয়েছিল। রাত্রে আমরা গাড়িতে উঁচু পাহাড়ে উঠে আলো সজ্জিত পাহাড়ের গায়ে শহরের মনোরম দৃশ্য আবলোকন করি। অতঃপর হোটেলে ফিরে এসে খানা ও নামায সেরে ঘুমিয়ে যাই। ফযর বাদ গোসল ও নাস্তা সেরে সকাল সাড়ে সাতটায় জামায়াতের অফিসে দায়িত্বশীলদের এক বৈঠকে বক্তব্য রাখি ও তাদের প্রশ্নের জওয়াব দান করি। বন্ধুরা আমার এই স্বল্প অবস্থান ও সংক্ষিপ্ত প্রগ্রামে মেটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না, তবুও তাদের থেকে বিদায় নিয়ে সকাল ৯-৩০ মিনিটে পেশওয়ারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। পথিমধ্যে পরিপুর ও আটকে চা পানের জন্য বিচুক্ষণ অবস্থান করি। এবোটাবাদ থেকে কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পরে পাহাড়ী এলাকা ছাড়িয়ে আমরা সমতল ভূমিতে এসে উপনীত হয়েছিলাম। আর রাস্তাও ছিল উত্তম তাই ১০০ কিলোমিটার বেগে গড়ি চালিয়ে এবোটাবাদ হতে প্রায় ১৭৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ১-১৫ মিনিটে আমরা পেশওয়ার উপস্থিত হয়ে জুমায়ার নামায আদায় করি। এদিন ছিল এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখ। নামায ও খানা খেয়ে জামায়াতের মেহমানখানায় বিশ্রাম নেই, অথঃপর পেশওয়রের উত্তরে উপজাতি এলাকা সংলগ্ন আরবাব সাঈদের বাড়িতে মাগরিব বাদ তার তাজিয়াতের জন্য হাজির হই। মরহুম সাঈদ ছিলেন স্থানীয় জমিদার এবং সীমান্ত জামায়াতে ইসলামীর ও নেতা। তার সাথে আমার খুবই হৃদ্যতা ছিল। তিনি কয়েকদিন আগে বালাকোট হতে গিলগিট যাওয়ার পথে ভূমিকম্পে পাথর ধ্বসে পাথরের আঘাতে ইন্তকাল করেন। উপর থেকে বড় এক খন্ড পাথর তার জীপ গাড়ির উপরে পতিত হলে তার আঘাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমি যতবারই পেশওয়ার সফর করেছি তার বাড়িতে মেহমান না হয়ে আসতে পারিনি। অতঃপর মরহুমের মাজার জিয়ারত করে তার পরিবারের লোকজনদের সাথে কিছুক্ষণ কাটিয়ে পেশাওয়ারে ফিরে আসি।
সকালে নাস্তা পর্ব সমাপ্ত করে জামায়াত অফিসে গিয়ে জামায়াত নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাত সেরে আফগান মুজাহিদদের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত জামায়াতের সার্জিকাল হাসপাতাল দেখতে যাই। হাসপাতালে মিসরীয় ডাক্তার আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানান এবং চিকিৎসাররত বিভিন্ন ধরনের আহত মুজাহিদদের রুমে রুমে ঘুরিয়ে দেখান, অতঃপর আমরা জামায়াত প্রতিষ্ঠত ইসলামী টেন্টে খেতে যাই। এখানে বিভিন্ন বিষয়ের উপরে লিখিত ইসলামী বইয়ের পশতু, ফার্সি ও রুশ ভাষায় অনুবাদ করা ও ছাপাবার ব্যবস্থা আছে। আফগান মুজাহিদরা নিজেদের জন্য ও দাওয়াতী কাজের ইদ্দেশ্যে অস্ত্রের সাথে সাথে এই ইসলামী কিতাবাদিও সাথে নিয়ে যায়।
পেশয়ারা মুজাহিদ নেতাদের সাথে সাক্ষাতকারঃ
বিকালে আসর বাদ আমরা মুজাহিদ ঐক্য ফ্রন্টের সদর দপ্তরে ফ্রন্ট নেতা আবদুর রব রসূল সাইয়াফ ও হিজবে ইসলামী নেতা গুলবদীন হিকমত ইয়ারের সাথে সাক্ষাত করে তাদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করি। সাইয়াফ জামেয়ুল আজহারের ডিগ্রীপ্রাপ্ত , ভাল আরবী জানেন। তাঁর আরবী বক্তৃতা আমি কয়েকবারই শুনেছি। গুলবদীন হিকমত ইয়ার একজন ইঞ্জিনিয়ার। মাগরিব বাদ জামায়াতের ভাইদের এক সম্মেলনে বক্তব্য রেখে অন্যতম মুজাহিদ নেতা জমিয়তে ইসলামী প্রধান রুরহানুদ্দীন রব্বানীর সাথে সাক্ষাতের জন্য তার বাড়িতে যাই। এদিন ছিল ১লা মে’১৯৮২ সাল। তিনি আমাদেরকে রাত্রের খানার দাওয়াত দিয়েছিলেন। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে ফ্রন্টে যুদ্ধের জন্য ১০০ জনের এক একটা গ্রুপকে পাঠান হত। এদিন বুরহানুদ্দীন রব্বানী ১শ’মুজাহেদীনের একটি জামায়াতকে ফ্রন্টে পাঠাবার উদ্দেশে তার বাড়িতে রাত্রের খানায় একত্র করেছিলেন। আমরাও মোজাহেদীনদের সাথে একত্রে বসে খানা খাওয়ায় আমি যে তৃপ্তি অনুভব করেছিলাম তা কোনদিনও ভুলতে পারব না। খানা সমাপ্ত করে রব্বানী সাহেবের সাক্ষাতকার গ্রহণ করে মেহমান খানায় চলে আসি। বুরহানুদ্দীন রব্বানী সাহেবও একজন ইলিমে দ্বীন। জামেয়ুল আজহারের ডিগ্রীপ্রাপ্ত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে তিনি ছিলেন কাবুল উনিভার্সিটির শিক্ষক। তার বাড়ি উত্তর আফগানিস্তানের বদখসান এলাকায়, মাতৃভাষা ফার্সী। হিকমত ইয়ারে বাড়ি দক্ষিণ আফগানিস্তনে। মাতৃভাষা পশতু।
ঢাকার উদ্দেশ্যে ফিরতি সফর ও কোলকাতায় অবতরণঃ
করাচীতে কর্মব্যস্ত কয়েকদিন কাটিয়ে বিমানযোগে সরাসরি ঢাকা রওয়ানা হই। আমাদের বিমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করতেই ঢাকা হতে সংকেত দেয়া হল যে, ঢাকার আবহাওয়া খুবই খারাপ। সুতরাং বিমান যেন কোলকাতা দমদম বিমান বন্দরে অবতরণ করে, এখানে অমরা প্রায় ৬ ঘন্টা বিমান বন্দরের ওয়েটিং কক্ষে অপেক্ষা করি। এই দীর্ঘ ৬ ঘন্টা বিমান আমাদের জন্য শুধু এক টুকরা করে কেক সরবরাহ করে, যাত্রীদের মধ্যে মহিলা ও শিশুও ছিল, ক্ষুধায় বাচ্চাদের খুবই কষ্ট হচ্ছিল। অতঃপর মাগরিব বাদ আমাদেরকে বলা হল যে, ‘ঢাকার আবহাওয়া ভাল হয়ে গিয়েছে, সুতরাং আপনারা বিমানে আরোহন করুন’। আমাদের আরোহনের পরে বিমান ১০ মিনিটের মত উড়ে আবার আমাদেরকে জানান ‘ঢাকার আবহাওয়া পুণরায় খারাপ হওয়ায় আবারও আমরা কোলকাতা বিমান বন্দরে ফিরে যাচ্ছি।’ বিমান হতে অবতরণ করে বিমান অফিসে আধা ঘন্টা অপেক্ষা করার পরে আবার আমাদেরকে বিমানে আরোহনের জন্য বলা হয়। বিমান আরোহনের পরে বিমান না উড়তেই আবার ঘোষণা করা হল যে, ঢাকার আবহাওয়া খারাপ হয়েছে, সুতরাং আপনারা নেমে পড়ুন। তখন আমি আমাদেরকে নিয়ে এ ধরনের ছেলেখেলা না করার জন্য পাইলটকে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানাই। অন্য যাত্রীরাও প্রতিবাদে আমার সাথে যোগ দেয়। প্রায় ৯ ঘন্টা আমরা উপবাস। বিমান আমাদের জন্য এই দীর্ঘ সময় কোন খানা পিনার ব্যবস্থা করেনি। তাই আমি প্রতিবাদ করে বল্লাম, আমাদেরকে রাত্রি যাপনের জন্য হোটেল ও খানার নিশ্চয়তা না দেয়া পর্যন্ত আমরা বিমান থেকে নামব না। পরে পাইলট আমাদেকে নিশ্চয়তা দিলে আমরা বিমান হতে অবতরণ করি। অতঃপর আমাদেরকে গাড়ি করে বিমান বন্দর হতে কিছু দুরে আশোক হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। হোটেলটি ভাইভ স্টার, ১ম শ্রেণীর হোটেল। অধিক রাত হওয়ার কারণে ভেটকী মাছ ফ্রাই ও ভেজিটেবল ছাড়া অন্য কিছু ছিল না বিধায় আমরা পাওয়া রুটি, মাছ ভাজি ও ভেজিটেবল খেয়ে যার যার কক্ষে গিয়ে নামাজ আদায় করে ঘুমিয়ে যাই। পরের দিন ভোরে উঠে নামায আদায় করে হোটেলের আঙ্গিনায় পায়চারী করতে হোটেলের সিকিউরিটি অফিসাররের সাথে আলাপ ও পরিচয় হয়। তিনি বললেন যে, ‘আমার বাড়ি খুলনায় ছিল। দেশ বিভাগের পরে কলিকাতায় চলে আসলেও আমরা সুখি নই। কেননা ভারতে বাংলা ভাষা এবং বাঙ্গালী জাতির অস্তিত্বের তেমন কোন নিদর্শন আর বাকী থাকছে না। আপনাদের জন্য আমরা গর্বিত, কেননা আপনারাই বাংলাদেশ, বাঙ্গালী জাতি এবং বাংলা ভাষার অস্তিত্বকে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন।’ ভদ্রলোকের এই সত্য ও স্পষ্ট কথায় আমি যেমন খুশি হয়েছিলাম, তেমন আশ্চার্যও। সত্যিই কলিকাতার পশ্চিমবঙ্গ বিমান বন্দরে আমি বাংলা ভাষার কোন সাইনবোর্ড দেখলামনা, সাইনবোর্ডগুলি ছিল হিন্দি ও ইংরেজী ভাষায়। এমনকি তেলের ট্যংকারেও হিন্দি লেখা ছিল। ভদ্রলোকের কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল যে পশ্চিম বাংলার সাহিত্যক বাবুরা তাদের দেশে বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলন না করে আমাদের দেশে বাঙলা ভাষা রক্ষার মায়া কান্না কাঁদেন কেন? পশ্চিম বাংলায় বাঙ্গালী জাতীঃয়তাবাদকে সর্ব ভারতীয় হিন্দি জাতীয়তাবাদের বেদীতে বলি দিয়ে বাংলাদেশে এসে উহাকে পুনর্জন্মদানের এ মায়া কান্না কেন? নিশ্চয় এর মধ্যে কোন রহস্য লুকায়িত আছে। সকালে নাস্তা সেরে রুমে এস পড়াশুনা করে সময় কাটাই, কেননা ভিসা না থাকার কারণে শহরে ঘোরা ফিরা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। যাহোক দুপুরের খানা খাওয়ার পরে আমাদেরকে আবার বিমান বন্দরে নিয়ে আসা হয়। অতঃপর বিমান বন্দরের অনুষ্ঠানিকতা সেরে আমরা বিমানে আরোহন করে আধা ঘন্টাখানেক উড়ে ঢাকায় অবতরণ করি।
ইসলামাবাদের ইউনিটি সম্মেলনে যোগদানঃ
লন্ডন ভিত্তিক ইসলামী কাউন্সিলে উদ্যোগে ১৬ ও১৭ ফেব্রুয়ারী’১৯৮৮ পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে দুইদিন ব্যাপী ‘ইউনিটি কনফারেন্স’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম উম্মার ঐক্য। মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশের প্রতিনিধি এ সম্মেলনে যোগদান করেন। এছাড়াও অমুসলিম দেশের ইসলামী দল ও আন্দোলনের প্রতিনিধিরাও এত যোগদান করেন। কয়েকটি দেশ যেমন সৌদি আরব, ইরান ও মালয়েশিয়ার সরকারী প্রতিনিধিরা এ সম্মেলনের স্ব স্ব দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। সৌদি প্রতিনিধি দলের নেতা ছিলেন মুহাম্মদ বিন সউদ ইউনিভার্সিটি রিয়াদের ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ আব্দুল্লাহ তুর্কী এবং চার সদস্য বিশিষ্ট ইরানী দলের নেতা ছিলেন সর্ব্বোচ্চ নীতি নির্ধারক সংস্তা ‘মুরুব্বি কাউসিল এর সদস্য আয়াতুল্লাহ জান্নাতী। পাকিস্তান ও আফগান মোজাহিদীনের প্রতিনিধি ছাড়াও মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতৃস্থানীয় প্রায় একশত প্রতিনিধি এত যোগদান করেন। ইখওয়ানুল মুলিমিনের মুরশিদে আম, মিসরের শেখ আবু নাসেরের নেতৃত্বে মিসরের ও সুদানের ৬ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল এতে যোগদান করেন। জাবহাতুল ইসলামিয়া সুদানে চার সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সুদানের সাবেক মন্ত্রী ও জাবহাতুল ইসলামিয়া পার্টির প্রেসিডেন্ট ডঃ হাসান তোরাবী। সুদান থেকে সাবেক সামরিক প্রধান ও সাবেক মার্শল’ল প্রধান জনাব সুয়েরোজাহাব ও সুদানের আরও একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী জনাব আলজাযুলি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। মিসরীয় পার্লামেন্টের বিরোধী দলের নেতা জনাব ইব্রাহীম সাকুরীও প্রতিনিধি হিসেবে সম্মেলনে তাঁর বক্তব্য রাখেন। জর্দানের দুই সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের প্রধান ছিলেন এডভোকেট আঃ রহমান খলিফা। নাইজেরিয়ার নয় সদস্য বিশিষ্ট দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শেখ সালেহ। লেবাননের চার সদস্যের নেতা ছিলেন সাইয়েদ সাবান। মালয়েশিয়ার তিন সসদ্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দলে নেতা ছিলেন মালয়েশিয়ার হেজবে ইলামীর সহ সভাপতি জনাব ডাঃ ফাজিল নূল। তুর্কীর মিল্লি সালামাত পার্টির চার সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের নেতা ছিলেন মিল্লি সালামত পার্টির (বর্তমান রেফা পার্টি) নেতা তুর্কীর সাবেক প্রধানমন্ত্রী জনাব নাজমুদ্দিন আরবাকান। তিউনিসিয়ার ‘হারকাতে ইত্তেজাহুল ইসলামী’ পার্টির সেক্রেটারী জেনারেল জনাব আবদুল ফাতাহ মমেরা তার দলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আফগানিস্তান প্রতিরোধ যুদ্ধের সাত দলীয় ফ্রনেটর নেতা মাওলানা ইউনুস খালিস এছাড়াও হিজবে ইসলামী নেতা গুলবদীন হিকমত ইয়ার, ইত্তেহাদে ইসলামী প্রধান আব্দুর রব রসূল সাইয়াফ, জমিয়াতে ইসলামী নেতা বুরহানুদ্দীন রব্বানী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তুর্কী সাইপ্রাসেরও দু’জন প্রতিনিধি এসেছিলেন। মিন্দানাওর (ফিলিপাইন) মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্টের চার সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল নূর মাইসুরীর নেতৃত্বে এ সম্মেলনে যোগদান করেন। ইরিত্রিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষের লোকও এখানে এসেছিলেন। এছাড়াও এশিয়া ও উইরোপের বিভিন্ন দেশের ইসলামী দলের প্রতিনিধিরাও এ সম্মেলনে যোগদান করেন। মোট কথা, মুসলিম উম্মার ঐক্যের ইদ্দেশ্যে অনিুষ্ঠিত এ সম্মেলন সবদিক দিয়েই প্রতিনিধিত্বমূলক ছিল। বেসরকারী উদ্যোগে অনুষ্ঠিত কোন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই বোধ হয় প্রথমবার ইরান ও সৌদি আরবের সরকারী প্রতিনিধিরা একত্রে বসলেন, এটা এ সম্মেলনের বিরাট কৃতিত্ব।
‘ইসলামাবাদ হোটেল’ নামীয় একটি উন্নত মানের ১ম শ্রেণীর হোটেলে প্রতিনিধিদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হোটেলটির পরিবেশ মোটামুটি ভালই ছিল। জামায়াতে নামায পড়ার ব্যবস্থা এবং প্রতি রুমে তাফসীরসহ কুরআন কারীম রাখার এন্তজাম হোটেলটির ইসলামী পরিবেশের পরিচায়ক। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের কে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য ইসলামাবাদ বিমান বন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে ইসলামী কাউন্সিলের প্রতিনিধি এবং পাকিস্তান সরকারের প্রোটকল অফিসার উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও ইসলামাবাদ হোটেলের লাউঞ্জে রিসিপশানের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। আমি করাচী ও লাহোর হয়ে ১৫ই ফেব্রুয়ারী সকাল ৮টায় পিআইএর বিমানে ইসলামাবাদ বিমান বন্দরে অবতরণ করি। বিমান বন্দরে ইসলামী কাউন্সিলের সেক্রেটারী জেনারেল জনাবা সালেম আযযাম এবং পাকিস্তান সরকারের প্রোটকল অফিসার আমাকে অভিনন্দন জানান। ইতিমধ্যেই এখানে বিবিন্ন দেশের আরও কয়েকজন বিশিষ্ট মেহমান উপস্থিত হয়েছিলেন। আমাদেরকে এখান থেকে ইসলামাবাদ হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশ থেকে আমরা দু’ন প্রতিনিধি আমন্ত্রিত ছিলাম। আমি এবং বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রধান ইমাম মাওলানা ওবায়দুল হক সাহেব। শেষ পর্যন্ত মাওলানা ওবায়দুল হক সাহেব অনুপস্থিত থাকায় আমি একাই বালাদেশ থেকে সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করি।
…………………………… অসম্পুর্ন
——————————————————————————————————————————–
পরবর্তি ইতিহাস আপনারা লিখুন !!!
আসান ফিকাহ ১ম ও ২য় খন্ড (২টি বই) ইসলামিক ই বোক ,প্রতিটা পরিবারের জন্য ক্বোরান হাদিস ও ফেকাহ’র জরুরী বই সমূহ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন