Bismillah

Bismillah

বৃহস্পতিবার, ৫ মে, ২০১৬

কোলেস্টেরল কমানোর সহজ উপায়

কোলেস্টেরল কমানোর সহজ উপায়
কোলেস্টেরল এক ধরনের চর্বিজাতীয় পদার্থ। পানিতে অদ্রবণীয় আঠালো তৈলাক্ত এই পদার্থটি সব ধরনের দেহকোষের দেয়ালে থাকে। আমরা প্রতিদিন যে সব চর্বিজাতীয় খাবার খাই মূলত তা থেকে আমরা কোলেস্টেরল পাই। শরীর এই কোলেস্টেরল থেকে হরমোন, বাইল এসিড, ভিটামিন ডি এবং অন্যান্য জরুরি উপাদান তৈরি করে যা আমাদের কাজে লাগে। কোলেস্টেরল শরীরের জন্য একটি জরুরি উপাদানও বটে।
কোলেস্টেরল কেন একটি সমস্যা
শরীরের জন্য যতটুকু কোলেস্টেরল দরকার তা শরীর নিজেই তৈরি করে। কোলেস্টেরল শরীরে রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। তবে জলীয় রক্ত তৈলাক্ত কোলেস্টেরল একসঙ্গে মিশতে পারে না। তাই কোলেস্টেরল পরিহনের জন্য লাইপোপ্রোটিন নামের বাহকের সাহায্য নিতে হয়। লাইপোপ্রোটিনের ভিতরে থাকে কোলেস্টেরল, বাইরে থাকে প্রোটিন।
দুই ধরনের লাইপোপ্রোটিন শরীরে কোলেস্টেরল সরবরাহ করে :
* এলডিএল বা লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন, যার আরেকটা নামব্যাড বা খারাপ কোলেস্টেরল; কারণ এই এলডিএল- ধমনী কোষকলায় কোলেস্টেরল পৌঁছে দেয়। রক্তের অধিকাংশ কোলেস্টেরল এলডিএল হিসেবে থাকে। যার রক্তে যত বেশি এলডিএল কোলেস্টেরল থাকে তার হৃদরোগের ঝুঁকি তত বেশি হয়।
* এইচডিএল বা হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন, যার আরেক নাম গুড বা ভালো কোলেস্টেরল; কারণ এই এইচডিএল কোষকলা থেকে কোলেস্টেরল লিভার বা যকৃতে পরিবহন করে নিয়ে আসে। লিভার পরিশেষে কোলেস্টেরলকে শরীর থেকে বের করে দেয়। রক্তে এইচডিএল কম থাকলে হৃদরোগের আশংকা বাড়ে।
যদি কারো শরীরে অনেক বেশি কোলেস্টেরল থাকে তবে এই কোলেস্টেলের কিছু কিছু রক্তনালীতে আটকা পড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আরও কোলেস্টেরল জমতে থাকে। এই জমতে থাকা কোলেস্টেরলের পরিমাণ এত বেশি হয় যে, এক সময় রক্তনালীর দেয়াল ফুলে ওঠে। তখন এটাকে বলা হয় প্ল্যাক। প্ল্যাক
ধমনীর ভিতরের অংশকে সরু করে এবং
ধমনীর নমনীয়তা কমিয়ে দেয়। এই অবস্থাকে বলা হয় ধমনীকাঠিন্য বা ইংরেজিতে অ্যাথেরোস্কোরোসিস।
এই অ্যাথেরোস্কে¬রোসিস শরীরের যে কোনো ধমনীতে হতে পারে। এমনকি হৃৎপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালন করে যে করোনারী আর্টারি বা হৃদধমনী সেখানেও অ্যাথেরোস্কে¬রোসিস হতে পারে। যদি হৃদধমনী প্ল্যাক দিয়ে আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যায় তখন সেটা হৃদপেশীতে পর্যাপ্ত রক্ত এবং পুষ্টি দিতে পারে না। অবস্থায় বুকে ব্যথা অনুভূত হয়। সেটাকে এনজাইনা বলা হয়ে থাকে।
কিছু কিছু প্ল্যাক ঠুনকো ধরনের হয়। এই প্ল্যাকগুলোর ওপরে যে আবরণ থাকে তা খুব পাতলা ধরনের হয়। ফলে সেই প্ল্যাক ফেটে গিয়ে তা থেকে বের হওয়া চর্বি রক্তে ছড়িয়ে পড়ে। যদি হৃদধমনীতে প্ল্যাক ফেটে যায় তাহলে হার্ট অ্যাটাক হয়।
যখন অ্যাথেরোস্কোরোসিস হৃদধমনী বা করোনারি আর্টারিকে আক্রান্ত করে তখন একে বলা হয় করোনারি আর্টারি ডিজিজ। যেহেতু রক্তে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল হৃদধমনীকে আক্রান্ত করে তাই কোলেস্টেরলকে হৃদরোগের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
কোলেস্টেরল বৃদ্ধির যে কারণ নিয়ন্ত্রণ
করা যায় না
কোলেস্টেরল মাত্রা হ্রাস-বৃদ্ধির কিছু কারণ আছে যেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, আর কিছু আছে যেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না সেগুলো হচ্ছে- বংশগতি, বয়স লিঙ্গ।
বংশগতি : কতটুকু কোলেস্টেরল আপনার শরীরে উৎপাদিত হবে এবং কত দ্রুত তা শরীর থেকে নির্গত হবে সেটা আংশিকভাবে নির্ভর করে জীন বা বংশগতির উপর। যদিও বংশগতির কারণে কোলেস্টেরলের উচ্চমাত্রা পরিবারে প্রবাহিত হতে পারে, তবু যদি কোলেস্টেরলের বিরুদ্ধে তার পর্যাপ্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেন তবে আক্রান্ত পরিবারের সব সদস্যেরই উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল নাও থাকতে পারে। আবার পরিবারে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরলে ভোগার কোনো ইতিহাস না থাকলেও সেই পরিবারের কেউ কেউ উচ্চ কোলেস্টেরলে আক্রান্ত হতে পারেন।
ইদানীং বাংলাদেশের অনেক মানুষ উচ্চ কোলেস্টেরলে আক্রান্ত হচ্ছেন, এমনকি পরিবারে উচ্চ কোলেস্টেরল থাকার ইতিহাস না থাকলেও। আবার অনেককে তুলনামূলকভাবে অনেক কম বয়সেই উচ্চ কোলেস্টেরলে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে।
বয়স এবং লিঙ্গ : ২০ বছর বয়স থেকেই রক্তের কোলেস্টেরল বাড়তে থাকে এবং ৬০-৬৫ বছর পর্যন্ত বাড়তেই থাকে। একজন ৫০ বছর বয়সী পুরুষের রক্তে যে পরিমাণে কোলেস্টেরল থাকে সমবয়সী একজন নারীর রক্তে সে পরিমাণ কোলেস্টেরল থাকে না। আবার ৫০ বছর বয়স পার হয়ে গেলে এটা উল্টে যায়। মানে ৫০-এর পরে নারীদের কোলেস্টেরলের মাত্রা সমবয়সী পুরুষের কোলেস্টেরলের মাত্রা থেকে বেশি থাকে।
কোলেস্টেরল বৃদ্ধির যে সব কারণ
নিয়ন্ত্রণ করা যায়
খাদ্য : তিন ধরনের খাদ্য আপনার শরীরে এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দিতে পারে।
* সম্পৃক্ত চর্বি (স্যাচুরেটেড ফ্যাট) : প্রাণীর দেহে থাকা তেল বা চর্বিই মূলত স্যাচুরেটেড ফ্যাট।
* ট্রান্স ফ্যাট : প্রক্রিয়াজাত হাইড্রোজেন সম্পৃক্ত উদ্ভিজ্জ তেলে ট্রান্স ফ্যাট থাকে; যেমন মার্জারিন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ইত্যাদিতে যে যে তেল থাকে।
* প্রাণীদেহ থেকে আসা কোলেস্টেরল।
উল্লেখ্য, উদ্ভিজ্জ তেলে কোনো কোলেস্টেরল থাকে না। যেমন- সরিষার তেল, রাইস ব্রান তেল, সয়াবিন তেল, সূর্যমুখী তেল ইত্যাদি। তবে এটা মনে রাখা জরুরি যে সব খাবারে স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাট এবং প্রাণীজ তেল আছে সেগুলোতে কোলেস্টেরল বাড়ে।
অতিরিক্ত ওজন : বেশি ওজন শরীরে এলডিএল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড বাড়িয়ে দেয় এবং এইচডিএল কমিয়ে দেয়। শরীরের ওজন কমালে এলডিএল কমে এইচডিএল বাড়ে এবং ট্রাইগ্লিসারাইড কমে।
ট্রাইগ্লিসারাইড কী
ট্রাইগ্লিসারাইড এক ধরনের ফ্যাট বা চর্বি যা লিভারে উৎপাদিত হয়। কিছু কিছু খাবারেও এটা থাকে। খাবারে বেশি শর্করা জাতীয় খাদ্য থাকলে এবং অতিরিক্ত ওজন, আয়েশী জীবন, ধূমপান, মদ্যপান ইত্যাদি শরীরে ট্রাইগ্লিসারাইড বাড়িয়ে দেয়। ট্রাইগ্লিসারাইড ১৫০-৪৯৯ মি.গ্রাম./ডিএল থাকলে তা হৃদরোগের ঝুঁকি কিছুটা বাড়িয়ে দেয়। ট্রাইগ্লিসারাইডের লেভেল ৫০০ মি.গ্রাম/ডিএল-এর উপরে গেলে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসার প্রয়োজন আছে। কারণ এই অবস্থায় প্যানক্রিয়াস বা অগ্নাশয়ে প্রদাহ হতে পারে, চোখের রেটিনা নষ্ট হতে পারে।
ট্রাইগ্লিসারাইড কমানোর জন্য ওজন কমাতে হবে, ধূমপান বন্ধ করতে হবে, মদ্যপান করা যাবে না, শর্করা বা চিনি জাতীয় খাবার কম খেতে হবে।
এলডিএল কোলেস্টেরলের চিকিৎসা
উচ্চমাত্রার এলডিএল কোলেস্টেরলের চিকিৎসায় থেরাপিউটিক লাইফ স্টাইল অনুসরণ করা প্রয়োজন। কখনও কখনও ওষুধেরও প্রয়োজন হতে পারে। তবে যে ধরনের চিকিৎসাই অনুসরণ করুন না কেন মূল চিকিৎসার ধারা হবে থেরাপিউটিক লাইফ স্টাইল। যদি আপনি কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ খেয়ে থাকেন তবে থেরাপিউটিক লাইফ স্টাইল অনুসরণ করলে সেই ওষুধের সর্বনিু মাত্রাই আপনার জন্য কার্যকর হবে। ছাড়া থেরাপিউটিক লাইফ স্টাইল অন্যান্য ঝুঁকিও কমায়, যেগুলো ওষুধ কমাতে পারে না; যেমন উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত ওজন, ডায়াবেটিস, রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা ইত্যাদি।
থেরাপিউটিক লাইফ স্টাইলের তিনটি অংশ
* খাদ্য : স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাট এবং কোলেস্টেরল কমানো, উদ্ভিজ্জ স্টেনল এবং স্টেরল যুক্ত করা।
* শারীরিক পরিশ্রম।
* ওজন নিয়ন্ত্রণ।
আপনার চিকিৎসার ব্যাপকতার সঙ্গে যুক্ত থাকবে আপনার হৃদরোগের ঝুঁকির সম্পর্ক। কিন্তু আপনার ঝুঁকি যাই হোক না কেন আপনাকে থেরাপিউটিক লাইফ স্টাইল কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। এই স্টাইল ধাপে ধাপে একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্যে আপনাকে অন্তর্ভুক্ত করবে, যেন আপনার জন্য এই নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করতে সুবিধা হয়। যেমন- প্রথম তিন মাসের চিকিৎসার লক্ষ্য হবে খাদ্য নির্বাচন পরিশ্রমের মাধ্যমে এলডিএল কমিয়ে আপনার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো। এই সময়ে আপনাকে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে, যেন প্রয়োজনে চিকিৎসার পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা যায়।
কোলেস্টেরল কমাতে সাফল্যের জন্য থেরাপিউটিক লাইফ স্টাইল
থেরাপিউটিক লাইফ স্টাইল প্রোগ্রাম এলডিএল কমানোর জন্য একটি ধারাবাহিক রুটিন। আপনাকে হৃদস্বাস্থ্য উপযোগী খাদ্য খেতে হবে। আয়েসী জীবন ত্যাগ করতে হবে। আপনি আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে একত্রে বসে এলডিএল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করবেন।
ডাক্তারের কাছে প্রথম ভিজিট রুটিন শুরু করুন
* সম্পৃক্ত চর্বি, ট্রান্স ফ্যাট এবং কোলেস্টেরল কমিয়ে দিন।
* সহনীয় মাত্রায় শরীরচর্চা বা হাঁটাহাঁটি শুরু করুন।
* যদি ওজন বেশি থাকে তবে ক্যালরি গ্রহণ কমান, ফাইবার বা খাদ্য আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া শুরু করুন।
* সপ্তাহ পরে আবার ডাক্তার দেখান।
ডাক্তারের কাছে দ্বিতীয় ভিজিট এলডিএল মাপুন
* সম্পৃক্ত চর্বি, ট্রান্স ফ্যাট কোলেস্টেরল আরও কমিয়ে দিন।
* উদ্ভিজ্জ স্ট্যানল স্টেরল যুক্ত করুন।
* দ্রবণীয় ফাইবার বা খাদ্য আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন।
* সপ্তাহ পর আবার ডাক্তার দেখান।
ডাক্তারের কাছে তৃতীয় ভিজিট এলডিএল আবারো দেখুন
* প্রয়োজন হলে ওষুধ যুক্ত করুন।
* মেটাবোলিক সিনড্রোমের চিকিৎসা শুরু করুন, ওজন কমানো অব্যাহত রাখুন।
* থেকে মাস পরপর আপনার অগ্রগতি পরীক্ষা করুন।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

প্রিন্ট পি ডি এফ

Print Friendly Version of this pagePrint Get a PDF version of this webpagePDF
“ডাক তোমার প্রভূর পথে প্রজ্ঞা এবং সদুপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক কর সর্বত্তোম পন্থায়” (সূরা নাহলঃ১২৫)